শিক্ষকরাও মানুষ। তাদেরও চাহিদা আছে। দাবিদাওয়া থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেই দাবি করার একটা যৌক্তিক ও সম্মানজনক ভাষা এবং পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করার জ্ঞান, রুচি ও মানসিকতা থাকা উচিত। যাতে শিক্ষকের সম্মান থাকে এবং সমাজের সবাই সেই দাবির পক্ষে কথা বলেন।
একদল শিক্ষক যদি এমন হয়, যারা প্রতি মিনিটে-ঘণ্টায় শুধু ‘চাই চাই, দেন দেন’, ভাতা দেন, বোনাস দেন, অনুদান দেন, সহায়তা দেন, প্রণোদনা দেন, সাহায্য দেন, ... দেন, লিখে লিখে ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট, লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার দিতে থাকেন তো বিষয়টি রাখাল ও বাঘের গল্পের মতোই হয়ে যায়। সেইসাথে তারা যদি আরও অনেক অশিক্ষক সাথে নিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সর্বদা সরকার ও সরকারি লোকদের তুলোধুনা করতে থাকেন তো দাবি আদায়ের চেয়ে সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হয়। দাবি আদায়ে যার সাথে টেবিলে আলোচনায় বসবেন তার সাথে মোটামুটি আলোচনা পেশ করার মতো তো একটা পরিবেশ ও সম্পর্ক রাখতে হবে। সকালে কাউকে ফেসবুকে গালমন্দ করে দুপুরে তারই কাছে গিয়ে দাবি পেশ করলে কেমন দেখা যাবে?
পূর্ব নির্ধারিত বেতন ভাতা ও বোনাস নিয়মিত প্রাপ্তির পরেও তারা যদি পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা না করে বিশ্বমহামারি করোনাকালে সরকারের পক্ষে যখন দেশের বিপুল সংখ্যক দিন মজুর, কাজের বুয়া, দোকানের কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রাস্তার শ্রমিক, সেলুনের শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, জুতার কারিগর, তালার কারিগর, ভ্যান চালক, রিক্সা চালক, গাড়ি চালক ও হেলপার, ফেরিওয়ালা, বানরওয়ালা, বাঁশিওয়ালা, মাঝিমাল্লা, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার ইত্যাদি পেশার কোটি কোটি বেকার মানুষ ও ভাসমান ফকির মিসকিনদের মুখে সামান্য খাদ্য দিয়ে জীবন বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়েছে; তখন ঘরে বসে বারবার ফেসবুকে পোস্ট দেন যে, আমাদেরকেও প্রণোদনা দিতে হবে। দয়া করতে হবে সাহায্য করতে হবে। আমরা বেসরকারি শিক্ষক, না খেয়ে মরে যাচ্ছি। আমরা খুবই বিপদে আছি। আমরা পাঠাও চালাতে বাধ্য হচ্ছি (অথচ, তখন লকডাউন)। এমন পরিস্থিতিতে এসব পোস্ট দেখে বিবেকবান মানুষমাত্রই প্রশ্ন করা স্বাভাবিক যে, এসব কী বলছেন, নিয়মিত বেতন ভাতা ও বোনাস পাওয়া শিক্ষকরা? তারা কাদের কাতারে দাঁড় করিয়েছেন নিজেদের? এই দাবিতে কেন করছেন সরকারের সমালোচনা? কীভাবে সত্য হয় লকডাউনে তাদের পাঠাও চালানোর কথা? প্রকাশ্যে এসব বললে, কী করে সম্মান ও মর্যাদা থাকে শিক্ষকের?
ভ্যাট-ট্যাক্স না দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে চরম অর্থনৈতিক সংকটকালেও সরকারকে যখন পূর্বের মতোই উপবৃত্তি, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদিসহ সকল সরকারি-বেসরকারি লোকদের নিয়মিত বেতন ভাতা ও বোনাস চালু রাখতে হচ্ছে (বিশ্বের অনেক দেশেই এখন বেতন অর্ধেক দেয়া হচ্ছে, বোনাস তো দূরের কথা); তদুপরি সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য কৃষি ও শিল্প খাতে দিতে হচ্ছে ব্যাপক প্রণোদনা; নতুন করে অনেক হাসপাতাল রেডি করে নিয়োগ দিতে হচ্ছে ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান। আমদানি করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মেডিকেল সামগ্রী; মওকুফ করতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ব্যাংক সুদ ও ভ্যাট-ট্যাক্স; আরও অনেক খাতেই সরকারের ব্যয় বেড়ে, আয় কমে অর্থনীতির চাকা প্রায় অচল; তখনও ঘরে বসে বসে সারাক্ষণ ফেসবুক গ্রুপে যদি তারা পোস্ট দেন যে- আমাদের ভাতা ও বোনাস বাড়িয়ে দিন, বদলি চালু করুন, জাতীয়করণ দিন এখনই। আমরা খুব বিপদে আছি। দীর্ঘ বছর ধরে আমাদের ভাতা ও বোনাস বাড়ানো হচ্ছে না। এবারই বাড়াতে হবে। আর সেই পোস্টে যদি শত শত লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট দেন অনেক শিক্ষক ও অশিক্ষক এবং সেইসাথে করে সরকারের তীব্র সমালোচনা (অথচ, তারা আগের মতোই পাচ্ছেন তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা ও বোনাস) তো প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কতটা সহজ-সরল ও বিবেকবান আমাদের শিক্ষক সমাজ?
যখন দেশের এই কঠিন ক্রান্তিকালে ভিক্ষুকও সরকারি ত্রাণ তহবিলে টাকা দেয়, তখন তারা যদি সরকারি বেতন থেকে একদিনের বেতনের সমপরিমাণ টাকা সরকারি ত্রাণ তহবিলেই দিতে অনীহা প্রকাশ করে পোস্ট দেন যে, একটাকাও দান করার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমরা ত্রাণ তহবিলে দান করতে পারবো না। বাধ্যতামূলক না ইত্যাদি। আর সেই পোস্টে দ্রুত সমর্থন দেন তাদের অনুসারীরা। এসবে তারা এতই সক্রিয় মনে হয় যেন শিক্ষকদের আর কোনো কাজ নেই এবং বাঁচার কোনোই উপায়-অবলম্বন নেই। তাদের মনোভাব মনে হয় এমন যে, আর সব মানুষ না খেয়ে মরে যাক, এখনই আমাদের বেতনের অতিরিক্ত প্রণোদনা চাই, ভাতা ও বোনাসের পরিমাণ বাড়ানো চাই, চাকরি সরকারিকরণ চাই, বদলি চাই। এই যদি হয় শিক্ষকের প্রকাশ্য মনোভাব তো তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে কীভাবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অন্যান্য মানুষের?
সকল পরিস্থিতিতে সারাক্ষণ শুধু চেয়ে বেড়ানোই যদি কারোর ব্রত হয় তো কী করে বজায় থাকে তার মর্যাদা? শুধু তাই নয়, এতে একজন শিক্ষকের জেনে মেনে গৃহীত এই কাজের সামান্য আয়ের বাইরেও যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কম/বেশি আয় বা সচ্ছলতা আছে, যা সাথে দিয়ে সে সবসময় জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে এবং সেক্ষেত্রেও যে তার আলাদা একটা মর্যাদা আছে সেটিও বিনষ্ট হয় এসব কারণে। কেউ কেউ আত্মীয়তা করতেও অনীহা দেখায় বেসরকারি শিক্ষকদের সাথে। যারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে জানে না, কেউ তাদের মর্যাদা দেয় না।
স্বাভাবিক সময়ে যৌক্তিক ইস্যুভিত্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলন ভিন্ন কথা। সেটি করার অধিকার সবারই আছে। অধিকার আছে রেজিস্টার্ড সংগঠন গড়ে তোলার। একেক আন্দোলনের কৌশলও একেক রকম। যথাসময়ে ঐক্যবদ্ধ সঠিক আন্দোলনে দাবিও আদায় হয়, মর্যাদাও বাড়ে। বীর পুরুষের মতো তা না করে সারাক্ষণ নাই নাই, চাই চাই, দেন দেন, বলে বলে অনুনয়, আকুতি, কাকুতি, বিনয় করতে থাকলে সে কথা আর কেউ কানে নেন না। বরং সবাই বিরক্ত হয়, স্বার্থপর ভাবে, অথর্ব ভাবে ও মূল্যহীন মনে করে। এসব করে, না হয় শিক্ষকদের দাবি আদায়, না থাকে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা। এ বিষয়ে সজাগ থাকা উচিত সকল বিবেকবান শিক্ষকের।
লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।