সীমানা প্রাচীরে লেখা, ‘শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও’। দারুল হুদা মহিলা মাদরাসা ও এতিমখানায় বড় করে লেখা এমন সব বাণী দেখে নির্ভয়ে ছিলেন অনেকে। তবে প্রতিষ্ঠানটির সীমানা প্রাচীরের ভেতরের ঘটনা অভিভাবকদের ধৈর্যের সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত এ মাদরাসার অধ্যক্ষ ১১ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন। গত ২৭ জুলাই বড় হুজুর নামে খ্যাত অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১। রোববার (৪ আগস্ট) কালের কণ্ঠ প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ কুমার মণ্ডল।
শুধু দারুল হুদা মাদরাসাই নয়, একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ফতুল্লার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদরাসা এবং সিদ্ধিরগঞ্জের অক্সফোর্ড হাই স্কুলে। এ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। বন্ধ হয়ে গেছে মাদরাসা দুটি। স্কুলটি চালু থাকলেও শিক্ষার্থী সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
গত ৪ জুলাই বাইতুল হুদা মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আল আমিনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে ১২ শিশুকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আছে। এর আগে ২৭ জুন অক্সফোর্ড হাই স্কুলের শিক্ষক আরিফুল ইসলামকে ২০ ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করে র্যাব। আর তাঁকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হন প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম।
নারায়ণগঞ্জের আরও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আছে বলে জানাচ্ছেন র্যাব কর্মকর্তারা। ওই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন র্যাব-১১-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন পিপিএম। তিনি বলছিলেন, ‘একটি স্কুল ও দুটি মাদরাসায় শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ ও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক ঘটনার খবর আমাদের কাছে এসেছে। সেগুলোকে আমরা নজরদারির আওতায় এনেছি, পর্যবেক্ষণ করছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, বছর পাঁচেক আগে দারুল হুদা মহিলা মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন মোস্তাফিজুর রহমান। ভুঁইগড়ের প্রবাসী আলাউদ্দিনের চারতলা ভবনের নিচের তলার পুরোটা ভাড়া নিয়ে সেখানে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ‘বড় হুজুর’ মোস্তাফিজুর ওই প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ পদে যেমন আছেন, তেমনই মহাপরিচালক পদও নিজের আয়ত্তে রেখেছেন। এর পাশেই ছেলেদের জন্য আরও একটি মাদরাসা পরিচালনা করতেন ‘বড় হুজুর’।
দারুল হুদা মহিলা মাদরাসা ভবনের দোতলায় বসবাসকারী ভাড়াটিয়া মরিয়ম আক্তার জানালেন, নিচের পুরো ফ্লোর ভাড়া নিয়ে মাদরাসা করা হয়েছে। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস চলত। তবে অযথা কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হতো না। ঘটনার পরপরই মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে গেছে।
গত ২৮ জুলাই দুপুরে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, হুজুরের কথা শোনা ফরজ; না শুনলে গুনাহ হবে, জাহান্নামে যাবে—এ রকম নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে ছাত্রীদের ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করেছে মোস্তাফিজুর রহমান।
ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আসলাম হোসেন জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার মোস্তাফিজ ওরফে বড় হুজুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
এদিকে ফতুল্লার মাহমুদনগর এলাকার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে গেছে। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির মালিক নুরুল সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি সংস্কারের কাজ করছেন। ইতোমধ্যে নামিয়ে ফেলা হয়েছে মাদরাসার সাইনবোর্ড।
নুরুল হক বলেন, মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আল আমিন এখনো জেলহাজতে। তাঁর পরিবার চলে গেছে কুমিল্লার মুরাদ নগরে। আল আমিন মাদরাসা পরিচালনার পাশাপাশি একটি মসজিদেও ইমামতি করতেন। তিনি যে এমন জঘন্য কাজ করবেন তা কল্পনায়ও আসেনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সেখানে চার বছর আগে বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন আল আমিন। মূলত শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হলেও সেই বাড়িতেই বসবাস করতেন পরিবারসহ। প্রায় ৭০ শিশু শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত সেখানে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফতুল্লা মডেল থানার এসআই মুহাম্মদ মাঈনুল ইসলাম জানান, প্রধান শিক্ষক আল আমিন তাঁর মুঠোফোন ও কম্পিউটারে পর্ণ ছবি রাখতেন। এসব দেখে তিনি ছাত্রীদের নিপীড়ন করতেন। পানি পান, বইপত্র গোছানোসহ নানা কাজের কথা বলে ছাত্রীদের নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে তিনি ধর্ষণ করতেন।
অন্যদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজিমিজি এলাকার অক্সফোর্ড হাই স্কুলে গিয়ে সেখানে ক্লাস চলতে দেখা যায়। কথা হলো স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মেয়ে সহকারী শিক্ষক সাদিয়া ইসলামের সঙ্গে। বাবা জামিন পাওয়ার পর অসুস্থ—এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অক্সফোর্ড স্কুলের ওপর দিয়ে একটি ঝড় বয়ে গেছে। এ কারণে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫৩০ থেকে অনেকটাই কমে গেছে। আশরাফুলের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া মাত্রই তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মীর শাহিন পারভেজ জানান, অক্সফোর্ড হাই স্কুলের শিক্ষক আশরাফুল আরিফ পাঁচ বছর ধরে পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণির বিভিন্ন ছাত্রীর সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করে আসছিল। পাস করিয়ে দেয়া, খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার মতো কথা বলে তিনি শারীরিক সম্পর্ক করে এর ভিডিও চিত্র ধারণ করতেন।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো করে যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, মাদরাসা ও কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠছে। নিয়মনীতি না মেনে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের তেমন নজর নেই। বাণিজ্যিক উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগে কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় না। ফলে দুশ্চরিত্রের লোকজন এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হাসিনা পারভীন বলেন, ‘যেভাবে নারায়ণগঞ্জে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে, তা নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। প্রতিটি স্কুল-মাদরাসায় নজরদারি বাড়ানো উচিত।’
সরকারি তোলারাম কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জীবন কৃষ্ণ মোদক বলেন, ‘যেভাবে আমাদের সামাজিক মূল্য বোধের অবক্ষয় ঘটেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক শিক্ষকও জড়িত হয়ে পড়েছে। এসব জঘন্য কর্মকাণ্ড রোধে শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) রেহেনা সুলতানা বলেন, ‘এক মাসে দুটি মাদরাসা ও একটি স্কুলে ৪৩ জন ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে সভা করেছি। ছাত্রী ও অভিভাবকদের আমরা সচেতন করার জন্য স্কুলে স্কুলে সভা করছি।’