শিক্ষকের মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ইউনেস্কো-আইএলও ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। শিক্ষক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতি গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষককে বঞ্চিত করে কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। এদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা নেই, একথা আমি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পারি। মর্যাদা বলতে বোঝায়, পেশাগত উচ্চ সম্মানের স্বীকৃতি, আর্থিক সর্বোচ্চ প্রাপ্তি, রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলে সর্বোচ্চ সীমায় অবস্থান করা। এর একটিও নেই শিক্ষকতা পেশায়। কেন এগুলো নেই তা বলতে অনেক সময় লাগবে। অতীতে কোনো দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা ছিল না। কখনো অপমানজনক গৃহশিক্ষকতা, কখনো পাঠশালায় অবহেলিত শিক্ষকতা, কখনো শিক্ষাদানের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড। অবহেলিত এক পেশার নাম শিক্ষকতা । যদিও সেই প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। উন্নত বিশ্বে শিক্ষকের মর্যাদা এখন তুঙ্গে। তারা এখন উন্নতির শিখরে। তবে বাংলাদেশের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ। এখানে শিক্ষকরা পদে পদে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হন। অপদস্থ হন পরিচালনা পরিষদ, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তাসহ নানা কর্তৃপক্ষ দ্বারা। প্রতিদিন শোনা যায়, কোনো না কোনো শিক্ষককে পেটানো হয়েছে, কেউ চাকরিচ্যুত হয়েছে, কারো মাথায় মল ঢালা হয়েছে, কারো মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে, কেউ শারীরিক-মানসিকভাবে আহত হয়েছে।
আরও দেখুন: বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন শুরু হলো যেভাবে (ভিডিও)
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, শিক্ষকরা পিছিয়ে যাচ্ছে তাদের মর্যাদা ও জীবনমানের দিক দিয়ে। শিক্ষকরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষক বেসরকারি চাকরি করেন। বেতন-ভাতার একটা অংশ তারা পেয়ে থাকেন যা জীবনধারণের জন্য অপর্যাপ্ত। অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী মনে হয় একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক নন। ভাবতে অবাক লাগে, একজন শিক্ষক যখন অশিক্ষিত বখাটে লোক দ্বারা শাসিত হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন নির্মমভাবে।
একজন শিক্ষক সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন, নিজেকে উৎসর্গ করছেন জাতি গঠনে। সেই শিক্ষক কী পাচ্ছেন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটাই এখন প্রশ্ন। আমাদের পাশের দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেয়া হয়েছে। শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ১৬-২০ ভাগ দেয়া হচ্ছে। আর বাংলাদেশে ১২-১৩ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি শিক্ষককে মর্যাদা প্রদান আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গঠন করা জাতির জন্য যেমন খুবই জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি একটি দক্ষ ও মর্যাদাশীল শিক্ষক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষকদের জন্য ব্যয় বিনিয়োগ মনে করে এখানে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষক হবেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী একজন নাগরিক। আর শিক্ষকতা পেশাকে একটি মহান পেশা হিসেবে গণ্য করতে হবে।
ইউনেস্কো-আইএলও রেজুলেশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি আজও। যার ফলে এদেশের শিক্ষক সমাজ এখনো বঞ্চিত, এখনো পিছিয়ে আছে অন্যদের চেয়ে। এই পিছিয়ে পড়া শিক্ষকদের আরও পেছনে রেখে জাতির সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির অঙ্গীকার করি আর সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আর শিক্ষাক্ষেত্রে সকল বৈষম্য নিরসনে শিক্ষা সরকারিকরণের আন্দোলন এখন সময়ের দাবি।
মো. আবুল বাশার হাওলাদার : সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন।