শিক্ষকদের মানসিক যন্ত্রণা : প্রাথমিকে চ্যালেঞ্জ - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের মানসিক যন্ত্রণা : প্রাথমিকে চ্যালেঞ্জ

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

বাঙালির শোকের মাস আগস্ট। এ মাসের ১৫ তারিখে খুনি চক্র বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ছোট্ট শিশু রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা প্রবাসে অবস্থান করায় বেঁচে যান।

এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ করেন। তিনি তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।” ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত রঞ্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় দেশ গড়া তথা অর্থনীতির মুক্তির সংগ্রাম।

ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল সে সময়ে আমাদের আজকের বাংলাদেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সব পুড়িয়ে ছারখার করে শুধু ছাই রেখে গিয়েছিল। বাস, ট্রেন, স্টিমার, লঞ্চ সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। ধ্বংসের মাঝে ধনী-দরিদ্র অনেকটা এক কাতারে অবস্থান করেছিল। অন্ন, বস্ত্র, শিশু খাদ্য, ঔষধ এক কথায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ছিল তীব্র সংকট। আলবদর, আলশামস, রাজাকাররা প্রতিদিন কোনো না কোনো খাদ্য, পাটের গুদাম জ্বালিয়ে দিত। সে সময় সারাদেশে রেশনশপ, ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু দেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ অবস্থা মোকাবিলা করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল শূন্য। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে ছিল লুকানো অস্ত্র। এ অস্ত্রের মাধ্যমে সারাদেশে ডাকাতি, রাহাজানি ছিল নৈমিক্তিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধু রক্ষী বাহিনী গঠন করে স্বল্প সময়ে কারফিউ দিয়ে সারাদেশের অস্ত্রের মহড়া নিয়ন্ত্রণ করেন। সীমাহীন অভাব যেখানে, যেখানে শুধু নেই আর নেই- সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ভাবলেন কী করে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা যায়। তাঁর ভাবনায় আসলো শিক্ষা ছাড়া এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক টেকসই মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানরা টাকার বিনিময়ে শিক্ষার সুযোগ নিতে পারে। তৃণমূলের গরিব মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারলে এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম বাস্তবে কার্যকর হবে না। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের শূন্য কোষাগার নিয়ে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রায় দেড় লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষক সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা পেয়েছে। কত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হলে তখনকার সময়ে তিনি এ কাজটি করতে পেরেছেন! সাধারণ মানুষ ও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে স্বল্প সময়ে এ বিশাল মানুষ যার হৃদয়ের আকৃতির পরিমাপ নির্ণয় করার ক্ষমতা কারো নাই, তাকে হারিয়ে বাঙালি জাতি তথা প্রাথমিক শিক্ষকেরা হয়েছিল অনেকটা এতিমের মতো। 

বিএনপি সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের চক্রান্ত করলে শিশু শিক্ষা পেছনে হাঁটতে শুরু করে। মরহুম রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে প্রাথমিক শিক্ষকসহ সকল কর্মচারীদের ভাগ্যে ইতিবাচক অর্জন হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর পথ ধরে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণসহ প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই বিতরণ করে, শিক্ষা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেন। যা সারাবিশ্বকে হতবাক করে দেয়। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়নের পথ ধরে আমরা আজ বিশ্বের দরবারে মাথা ঊঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি।

বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন সর্বশীর্ষে। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক হিসিবে কর্মরত থাকাকালে আমাকে ও লালবাগ থানার শিক্ষক সেলিমুজ্জামানকে বিএনপি সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে জেল-হাজতে যেতে হয়েছিল। সে আন্দোলনে প্রাথমিক শিক্ষকেরা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর স্কেল থেকে মুক্ত হয়ে অফিস সহকারীর স্কেল প্রাপ্ত হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতনের কথা চিন্তা করে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণি ও সহকারীদের বেতন স্কেল উন্নীত করেন। অথচ এর মধ্যে হয়ে গেল বিশাল বৈষম্য। সকল সরকারি কর্মচারীর ২য় শ্রেণির মর্যাদা প্রাপ্তদের ১০ম গ্রেড, অথচ প্রাথমিকে ১১তম গ্রেড। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৫তম গ্রেড। সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রত্যাশা ১ ধাপ নিচে ১১তম গ্রেড।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ষড়যন্ত্র ও মানসিক যন্ত্রণার কবলে প্রাথমিক শিক্ষকেরা। সাবেক মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক ষড়যন্ত্রের মুলা ঝুলিয়ে সময়ক্ষেপণ করে চলে গেছেন। বর্তমান প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও ১১তম গ্রেড না দিয়ে অপকৌশল করে এগুচ্ছে। যা প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশ হচ্ছে। তাদের অপকৌশল প্রাথমিকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করে প্রধান শিক্ষক ১০ম গ্রেড, সহকারী প্রধান শিক্ষক ১১তম গ্রেড, সহকারী শিক্ষককে ১২তম গ্রেড দেয়া। এতে সহকারী শিক্ষকেরা বৈষম্যের শিকার হয়। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক ৫ বছর আশ্বাসের পর নতুন করে ষড়যন্ত্র ও প্রাথমিকের সহকারীদের অন্তরে কষ্ট দেয়া। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রাথমিক শিক্ষা। 

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রধান শিক্ষকদের ১০ টাকা দায়িত্ব ভাতা দিয়ে সরকারিকরণের যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসারের বেতন স্কেল একই। তারা শুধু সিনিয়রিটির ভিত্তিতে বেতন বেশি পান। বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষক নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে। এ পদের জন্য শিক্ষকদের প্রত্যাশিত কোনো স্কেল নাই। সম্মানিত পদ হিসেবে এ পদের জন্য দায়িত্ব ভাতা দেয়া হলে শিক্ষকদের কোনো ক্ষোভ বা মানসিক কষ্ট থাকবে না। প্রাথমিক শিক্ষার অশান্ত পরিবেশ দূর হবে।

রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহিদুল ইসলাম সহকারী প্রধান পদে ৩০ টাকা দায়িত্ব ভাতার ফাইলে স্বাক্ষর করেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের পূর্বে সরকারের পতন হয়। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, সচিবের প্রতি সবিনয় নিবেদন প্রাথমিক শিশু শিক্ষার প্রধান কারিগর সহকারী শিক্ষক। তাঁদের মনোবাসনা অনুযায়ী যৌক্তিক ১১তম গ্রেড প্রদান করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করুন।

আর নয় সময়ক্ষেপ। প্রাথমিকের সহকারীদের দাবি বাস্তবায়ন হোক প্রধান শিক্ষকদের পরের স্কেল। এ প্রত্যাশায়।

লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিকশিক্ষা ডটকম।

ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত - dainik shiksha ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল - dainik shiksha শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল - dainik shiksha ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073919296264648