গোটা দুনিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে রেনেসাঁ, শেকসপিয়ার, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইউরোপীয় সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাবৎ নিরীক্ষা, মার্ক্স, লেনিন—সব কিছুতেই ছিল তাঁর পর্বততুল্য পাণ্ডিত্য। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে বরণ করেন। ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় দফায় পান একই পদ। কিন্তু পদ তো দূরে থাক, ডিগ্রি থেকে সংসার—অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মোহ ছিল না কিছুতেই। নেশা একটাই—যতক্ষণ শ্বাস, জ্ঞানার্জনের জন্য হাঁসফাঁস। ছিল না বড়সড় কোনো সন্দর্ভ রচনা কিংবা সাহিত্যকর্ম। তাই প্রজন্মের ব্যবধানে আব্দুর রাজ্জাক ক্রমে ধোঁয়াশাঢাকা একটি চরিত্র হতে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ যাত্রা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে গুটিকয়েক রচনা। আব্দুর রাজ্জাকের পাণ্ডিত্যের দলিল পাওয়া যায় তাঁর স্নেহভাজন ও আশীর্বাদপুষ্ট এমন কিছু গুণী মানুষের কাছে, যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন প্রাণভরে।
আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ যত দিন লোকে পড়বে, তত দিন প্রকৃত শিক্ষক পদে বহাল আব্দুর রাজ্জাক। প্রয়াত আরেক গুণী শিক্ষক হুমায়ুন আজাদও ছিলেন আব্দুর রাজ্জাকের ভক্তপ্রতিম, তাঁর দাবা খেলার নিত্যসঙ্গী। হুমায়ুন আজাদের ‘সাক্ষাৎকার’ নামের ছোটখাটো বইটাও মহীরুহের মতো হয়ে যায় শুরুতেই থাকা আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারের কারণে।
১৯১৪ সালে জন্ম নেওয়া জ্ঞানের পিপাসায় সদা তৃষ্ণার্ত মানুষটা সংসারী ছিলেন না। সাদাসিধে বলতে যা বোঝায়, তার চেয়েও সরল জীবন কাটিয়েছেন। তবে যে জীবনের আগাপাছতলায় শুধু বই আর বই, সে জীবন সাদাসিধে হলেও সাধারণ নয়!
১৯৩৫ সালে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পর তাঁর মনে হলো প্রথম শ্রেণি পাবেন না, এ জন্য মৌখিক পরীক্ষাই দেননি। পরের বছরের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। মৌখিকের পরদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী লেকচারার পদে নিয়োগপত্র পান। শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন? ‘সাক্ষাৎকার’-এ অকপটে স্বীকার করেছেন নিজের কিছু দুর্বলতার কথা—‘ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হতো। মনে হতো—আহা, ওদের কোনো কিছুতেই কোনো আগ্রহ নাই! আমার কথায় তো নয়ই। দু-একটি ছাত্র আমাকে জানিয়েছিল আমি নাকি এক-আধটি ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে যেতাম। পুরনো কলা ভবনে আমার ক্লাসের পাশেই ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরে অনেক হাঁস ভাসত। আমি জানালার বাইরে পুকুরের হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘণ্টা শেষ করতাম।’
১৯৪৫ সালে উচ্চশিক্ষা নিতে আব্দুর রাজ্জাক ভর্তি হয়েছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে। সেখানে পিএইচডির থিসিসে রেফারেন্স লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন বলে তাঁকে ছয় মাস বাড়তি সময় দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে মন সায় দেয়নি তাঁর। ডিগ্রি না নিয়েই ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর আর কোথাও যাননি।
কিন্তু অন্য সব জ্ঞানতাপসের মতো কেন অন্তত একটা বড়সড় বই লিখে যাননি আব্দুর রাজ্জাক? অন্তত একটা-দুটো সাহিত্যকর্ম তো থাকতে পারত। এর একটা সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যায় আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’তে—‘যৌবনে যে মানুষ ট্রটস্কির থিওরি অব পার্লামেন্ট রেভ্যুল্যুশনের বাংলা এবং অবন ঠাকুরের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, সেই মানুষের পক্ষে অন্য কোনো মামুলি বিষয়ে কাজ করা অসম্ভব ছিল। তাঁর মানসিক সূক্ষ্মতার এমন একটা সমুন্নত উত্তরণ ঘটেছিল, সেখান থেকে তৎকালীন বিদ্যাচর্চার স্তরটিতে নেমে আসা সত্যি সত্যি দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’
আব্দুর রাজ্জাককে কেন শিক্ষকদের শিক্ষক বলা হতো, কোন কোন বই, বিষয়, তত্ত্ব ও ইতিহাস তাঁর ঠোঁটের ডগায় ছিল, সেসব জানতে আহমদ ছফার বইটা পড়ার বিকল্প আর হতে পারে না। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন তাঁদেরই তিনি উদ্দীপ্ত করেছেন জ্ঞানচর্চায়। আশি ও নব্বইয়ের দশকের অনেক নামিদামি জীবিত ও প্রয়াত শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী যখন পিএইচডি থিসিসের টপিকসংকটে ভুগতেন, কেউ না কেউ তাঁদের কানে কানে পরামর্শ দিতেন, ‘তুমি রাজ্জাক সাহেবের কাছে যাও, তাঁর মতো পণ্ডিত আর একজনও নেই।’ (যদ্যপি আমার গুরু)
ফয়সল আবদুল্লাহ