শিক্ষকরাই নিজেদের সম্মান ধরে রাখতে পারছেন না - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকরাই নিজেদের সম্মান ধরে রাখতে পারছেন না

মামুন-অর-রশিদ |

I am not a teacher, only a fellow traveller to whom you asked the way -জর্জ বার্নার্ড শ।

শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। কোনো জাতি সমৃদ্ধ কিনা তার শিক্ষাব্যবস্থা লক্ষ করলে তা অনুধাবন করা যায়। শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুর পরিবারই প্রথম পাঠ এবং তারপরে শিক্ষাদানের মহৎ দায়িত্ব এসে পড়ে শিক্ষকের ওপর। একজন শিক্ষকই পারেন নিজের অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তার শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলতে। চাণক্য বলেছিলেন, শিক্ষককে কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। সৃষ্টি ও ধ্বংস দুইয়েরই বীজ লুকিয়ে আছে শিক্ষকের মধ্যে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে আমরা বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যে সম্পর্ক দেখতে পাই তা আমাদের সমাজ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের অবনতি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। একজন শিক্ষক যখন তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যান তখন শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়ে। দুর্বল নৈতিকতা, অনৈতিক কাজে জড়ানো, ক্ষমতার অপব্যবহার, ছাত্রদের মতামতকে অবমূল্যায়ন করা, পক্ষপাতিত্ব করা, আইন না মানা, অসদাচরণ করা, অতিরিক্ত শিক্ষক রাজনীতি, ক্লাসে প্রাসঙ্গিক বিষয় সামনে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ইত্যাদি লক্ষ করা যায়। তাছাড়া দায়িত্বে অবহেলা করার মতো দিকটি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া শিক্ষকদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে যেসব রিপোর্ট আসে তা আমাদের মর্মাহত করে।

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, কিন্তু এটি এখন ব্যবসার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, শিক্ষকরা মূলধারার পাঠদানে সময় কম দিয়ে সান্ধ্যকালীন পাঠদানে বেশি সময় দিচ্ছেন, যার মূলধারার শিক্ষা হুমকির মধ্যে পড়ছে। শিক্ষক হবেন ছাত্রের গর্ব, ছাত্র হবে শিক্ষকের অহঙ্কার। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা অনুপস্থিত। ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শিক্ষকরা সমর্থন দেন না বরং আন্দোলনের নেতাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেন। শিক্ষক মহলে আজ আমরা ড. শামসুজ্জোহাদের দেখতে পাচ্ছি না। ছাত্র-শিক্ষকের মিলনমেলার মতো পরিবেশ আমরা লক্ষ করছি না। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কর্মীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে, খেলার মাঠে খেলোয়াড় হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমরা লক্ষ করি, প্রশাসনিক দায়িত্বে থেকেও দায়িত্বে চরম অবহেলা করা হয়।

বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বহিরাগতদের মাদকসেবন ও ব্যবসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নানাভাবে উত্যক্ত করার দিকটি অহরহ ঘটছে। আবাসিক হলগুলোতে হলের প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হলেও ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধার দিকটি দেখা হয় না। হলের মধ্যে নিম্নমানের খাবার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা ছাড়াও বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। হলগুলোর অফিসরুমে আবাসিক শিক্ষকদের বরাদ্দকৃত রুম এবং নেমপ্লেট থাকলেও তাদের দেখা মেলে না। হাউস টিউটর হিসেবে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকের বছরে ১-২ বার দেখা মেলে, হলের মধ্যে তার আবাসন ব্যবস্থা থাকলেও তিনি হলে অবস্থান করেন না। জাতীয় দিবসেও সব শিক্ষককে দেখা যায় না। সমন্বয়হীনতাই এর মূল কারণ। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাবে এ ধরনের সমস্যার সমাধান হয় না। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে নামমাত্র তদন্ত কমিটি করা হয়। কোনো ফলাফল বা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। একজন শিক্ষক যদি কোনো অনৈতিক কাজ করেন, তা প্রকাশ পেলে ছাত্র তাকে আদর্শ হিসেবে নিতে পারে না। থিসিস জালিয়াতি, গবেষণাপত্র নকলের প্রমাণ মিললে ছাত্ররা সেই শিক্ষকের ওপর আস্থা হারায়। শিক্ষকের প্রতি অকারণে উত্তেজিত হওয়া, বাজে ভাষা প্রয়োগ ও অপমান করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। মূলত সঠিক ব্যক্তিটি সঠিক জায়গায় আছে কিনা- সে প্রশ্নটি সামনে এসে যায়। শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, তুলনামূলক কম মেধাবীকে শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

অন্যদিকে আমরা ছাত্ররা নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছি। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকের ওপর হামলা, অন্য শিক্ষকদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তাকে অপসারণের জন্য আন্দোলন, শিক্ষককে কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা, অসদাচরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার মতো কাজ করে থাকি। ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল ছাত্র রাজনীতি। প্রতিহিংসা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছে। ’৬০ কিংবা ’৭০-এর দশকে ছাত্র রাজনীতির অবস্থা বর্তমান সময়ের মতো ছিল না। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির ধরন বদলে গেছে। আজ আমরা আমাদের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি। মানুষের মধ্যে সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে ছাত্রকে শিক্ষকদের ওপর শ্রদ্ধাশীল এবং শিক্ষককে ছাত্রের ওপর স্নেহশীল আচরণ করতে হবে। তবেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক শিক্ষাব্যবস্থার বুনিয়াদকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে।

মামুন-অর-রশিদ : সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: যুগান্তর

স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল - dainik shiksha স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006350040435791