শিক্ষকের কাঁধে শিক্ষার্থীর লাশ - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকের কাঁধে শিক্ষার্থীর লাশ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমার শিশুপুত্রটি দেশসেরা স্কুলে ভর্তির আনন্দে আপ্লুত থাকার মাঝেই একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল বিষণ্ন অবয়বে, তার চোখে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। সে বলল, ‘জানো মা, আজ এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। তুমি বিশ্বাসই করবে না আমাদের ক্লাসে যার রোল নম্বর-৪, সেও মারামারি করে।’ আমি খুব বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ছাত্ররা মারামারি করে আর মাস্টার কী করেন? তারা ছাত্রদের শাসন করতে পারেন না?’ এ ঘটনার প্রায় দুই দশক পর যখন রোল নম্বর ৪ থাকার মতো মেধাবী ছাত্ররা তাদের মতোই মেধাবী নিরপরাধ সহপাঠীকে হত্যা করে ফেলে তখন মাস্টাররা অর্থাৎ শিক্ষকরা- এই আমরা কী করি? আমরা নিম্নোক্ত কাজের যে কোনো একটি বা একাধিকটি করি- ১. ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজেদের অক্ষমতার গ্লানিতে ভুগি কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করি না, কারণ তার ফলে নিজের জীবনেও কোনো ভয়াবহ পরিণতি ঘটতে পারে, এই ভয়ে ২. ভয়াবহ পরিণতি না ঘটলেও ন্যায্য পাওনার ক্ষেত্রে (বৃত্তি, পদোন্নতি ইত্যাদি) যেন হেনস্তা বা বঞ্চনার শিকার হতে না হয় সেজন্য নীরব থাকি ৩. এ ক্ষেত্রে আমার কিছুই করণীয় নেই বলে কিছুদিন পর বিষয়টি ভুলে যাই ৪. কিছু দলবাজ শিক্ষক একটি ভিন্নমতাদর্শী আপদ বিদায় হয়েছে বলে নিজ গন্ডিতে উল্লসিত হই ৫. কিছু শিক্ষক নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে, শুভাকাক্সক্ষীদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, পত্রিকায় ছাপানোর উদ্দেশ্যে কলাম লিখে পাঠাই কিন্তু পত্রিকার প্যানেল লেখকদের ভিড়ের কারণে তা আর প্রকাশিত হয় না। শনিবার (১২ অক্টোবর) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, পুরো বিষয়টি সংক্ষিপ্ত করলে এই দাঁড়ায় যে, শিক্ষাঙ্গনে ক্রমাগত লাশ পড়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ দায়ী- ১. শিক্ষক রাজনীতি ২. রংবিহীন শিক্ষকদের আত্মকেন্দ্রিকতা ও নির্লিপ্ততা এবং ৩. ভয়ের সংস্কৃতি। শিক্ষক রাজনীতিতে যখনই আদর্শের পরিবর্তে ভোগবাদী মানসিকতা ও ক্ষমতার দাপটের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তখনই শুরু হয়েছে প্রকৃত শিক্ষকের পরিবর্তে ‘ভোটার শিক্ষক’ নিয়োগ ও প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্তকরণ। এখানে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে যে সম্পর্ক বা আঁতাত তৈরি হয় তাতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত দুঃসাহসী ও অপ্রতিরোধ্য হতে থাকে, লুপ্ত হতে থাকে শ্রদ্ধা-স্নেহের চিরায়ত সম্পর্কটি। দলকানা রাজনীতিবিদ শিক্ষকরা এসব শিক্ষার্থীকে প্রশ্রয় দেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, যার কারণে তারা অবাধ্য হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। ফলে শিক্ষার্থীদের অনৈতিক কার্যকলাপে বাধা দেওয়ার নৈতিক অবস্থান তাদের থাকে না অথবা এখানেও থাকে পারস্পরিক আদান-প্রদান। এ আদান-প্রদান প্রধানত ক্ষমতাকেন্দ্রিক, যার শিকড় বহুদূর বিস্তৃতি। এই চক্রের মাঝে ব্যবহৃত হতে থাকে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা, বলি হতে থাকে অপরাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয় এমন শিক্ষার্থীরাও। এসব শিক্ষক যদি একবারও এই বলি দেওয়া শিক্ষার্থীদের মুখে নিজের সন্তানের মুখটি দেখতে পেতেন; যদি এসব শিক্ষার্থীর লাশ নিজের কাঁধে নেওয়ার দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন তাহলেও কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্র-শিক্ষক অপরাজনীতি বহাল থাকত? এভাবে দেখার মহালগ্ন আজ উপনীত। এবার আসি আত্মকেন্দ্রিকতা, উদাসীনতা ও দায়বদ্ধতাহীনতার বিষয়ে। একজন ছাত্রকে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এত ভয়াবহভাবে নির্যাতন করা হলো তার খবর হল প্রশাসন জানল না কীভাবে? হলে যে টর্চার সেল আছে, সেখানে মদের আসর বসে হল কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, প্রক্টরিয়াল বডি এসব বিষয়ে অবগত নন এর চেয়ে বড় উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা আর কী হতে পারে।

আমার সেই পুত্রের আরেকবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল দেশসেরা প্রতিষ্ঠান বুয়েটে ছাত্র থাকাকালে, হল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি অন্তত রাতে ক্যাম্পাস ও হল প্রদক্ষিণ করে। এর মাঝেও যে অঘটন ঘটে না তা নয়, তবু শিক্ষার্থীরা কিছুটা সংযত থাকার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এ আত্মকেন্দ্রিকতা ও নির্লিপ্ততা ছাত্রদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তাদের কেউ কি হল কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশকে একটা ফোনও দিতে পারেনি? নাকি এখানেও কাজ করেছে ভয়ের সংস্কৃতি? তবে সাহসী ছাত্ররা পরবর্তীতে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ভয়কে উপেক্ষা করে তখন যদি তারা এভাবেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্যাতন থামাতে পারত তাহলে হলে হলে টর্চার সেলের অস্তিত্ব থাকত না। হত্যাকান্ডে জড়িত ছাত্ররাও তো এই ভয়াবহ ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির বলি। ভোগবাদী অপরাজনীতির মোহনীয় মোহজালে কে তাদের টেনে এনেছে? হলের ন্যায্য সিট পাওয়ার জন্য অথবা নবাগত শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে অনিচ্ছুক অনেক শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বাধ্য হয়ে জড়াতে হয়। এখানে কি হল প্রশাসনের নজরদারি জরুরি নয়? এখানেও কাজ করে দলীয় আনুগত্য অথবা ভয়ের সংস্কৃতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে ছাত্র-শিক্ষক অপরাজনীতি বন্ধ করা। এর সঙ্গে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাইরের সব প্রভাবমুক্ত রাখা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন শিক্ষকদের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থার কারণে। তাঁর এ আস্থার জায়গাটিকে নষ্ট করার অর্থ হচ্ছে তাঁকে অসম্মান করা। এই স্বায়ত্তশাসনের কারণেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা মেরুদ- সোজা রাখতে পারেন। আজ এই মেরুদ- সোজা রাখা শিক্ষকের বড় প্রয়োজন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য- ‘শিক্ষকরা সাধারণ মানুষ নন এবং সাধারণ মানুষরা শিক্ষক নন। সাধারণ মানুষদের শিক্ষক হওয়ার সাহস দেখানো উচিত নয়।’ আজ আমাদের সেসব নিবেদিতপ্রাণ, পদ-পদবি মোহমুক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন যাদের হাত শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রসারিত থাকবে বিতরণের জন্য, গ্রহণের জন্য নয়। আজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বড় দায়িত্ব বিচারের নামে প্রকৃত দোষীদের আড়াল করে কোনো নিরপরাধ ছাত্র যেন বলি না হয় তা নিশ্চিত করা, অন্তত এটুকু দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া। আর নির্লিপ্ততা বা উদাসীনতা নয়।

সুলতানা মোসতাফা খানম : প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037441253662109