শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার দায় - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার দায়

গোলাম কবির |

‘কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবি দিল্লির’—সেই মৌলবি অর্থাৎ শিক্ষককে যথাযোগ্য সম্মানদানের জন্য  বাদশাহ আলমগীর নিজের সন্তানকে যে পথনির্দেশ করেছিলেন সেই ঘটনা কল্পনাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করে কবি কাদের নাওয়াজ ‘উস্তাদের কদর’ কবিতায় আবেগকম্পিত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন—‘আজি হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির।’ আমরা শিক্ষকসমাজ এই ঘটনা মানসচক্ষে অবলোকন করে ক্ষণিকের জন্য হলেও আপ্লুত হই।

নিজেকে শিক্ষক ভেবে গর্ব বোধ করি। ইতিহাস-আশ্রিত এই ঘটনার উল্টো পিঠও আছে আমাদের সমাজে। কোনো এক মৌলবি সাহেব (শিক্ষক) জনৈক অবস্থাপন্ন ব্যক্তির গৃহশিক্ষক ছিলেন। একদিন হঠাৎ অকারণে এক বাটি দুধ পানের জন্য তাঁকে পরিবেশন করা হলে তিনি বিস্মিত হয়ে শিশুটির কাছে এর মোজেজা জানতে চান। শিশুটি উত্তরে যা বলেছিল, তার পরিচয় কাজী নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে বর্ণিত দারোগা গিন্নির প্যাকালেদের অযাচিত দুধ উপঢৌকন দেওয়া থেকে লাঞ্ছিত শিক্ষক তথা মানবসমাজের চিত্র পাওয়া যাবে। অথবা টমের জন্য কেনা বিস্কুট শিক্ষককে পরিবেশনেও তথাকথিত ওপরতলার মানুষের মানসিকতা লক্ষ করা যায়। লেখা বাহুল্য, টম পয়সাওয়ালা লোকের পালিত সারমেয়।

অনুকম্পা প্রদর্শন অথবা অবজ্ঞা পোষণ কোনোটিই জাত শিক্ষককে বিচলিত করে না। সহজাতভাবেই শিক্ষক উচ্চশির। তিনি স্রষ্টা, পিতা-মাতা এবং নিজ শিক্ষক ছাড়া কারো কাছে মাথা নোয়ান না। এ জন্য বোধ করি স্রষ্টা ধর্ম প্রবর্তকদের নির্ধারিত কোনো শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে দেননি।

আজকের দিনে আমরা শিক্ষকসমাজ আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অনুকম্পা প্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল। কে কতখানি উলঙ্গভাবে মোসাহেবি করে বাঞ্ছিত বিষয় করায়ত্ত করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। এর চেয়ে অবমাননাকর পন্থা বোধ করি উদ্ভাবিত হয়নি।

অর্থশাস্ত্র বলে, চাওয়ার শেষ নেই। এটা মানুষের স্বভাবজাত। এখানেই সাধারণ মানুষ ও শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য হলো—শিক্ষক জ্ঞানের বিষয় ছাড়া জাগতিক জৌলুসে গা ভাসাবেন না। তিনি হবেন ব্যতিক্রম। এ ক্ষেত্রে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নির্মোহভাবে বেছে নিতে হবে খাঁটি ও মেকি শিক্ষক কারা। পরিতাপের বিষয়, যাঁরা এই দায়িত্ব বহন করার ভার পান, তাঁদের অনেকে তোষামোদ আর হলুদ খামের দৌরাত্ম্যে নৈতিকতা বিসর্জন দেন। ফলে শিক্ষকের খাতায় নাম লেখিয়ে তেলের ভাণ্ড আর চাঁদির জুতা উপহার দিয়ে কেউ কেউ বেমানান পদে অধিষ্ঠিত হন। এঁরা দৃষ্টিকটু কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হয়ে উপহাসের পাত্রে পরিণত হন। জাত শিক্ষক পদ-পদবি, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য, পুরস্কার অথবা আত্মরক্ষার জন্য অবনত হন না, যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সক্রেটিস। এঁরা পোষ্য ফরমানবরদার বা আজ্ঞাবহ হন না। আইনকে যথাযথ শ্রদ্ধা করেন; কিন্তু মানব মুক্তিবিরোধী আইনের প্রতি অনুগত থাকতে নারাজ।

আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মওলানা তাহের উদ্দিন, অনেকটা রবীন্দ্র-প্রশংসিত অমৃতসরের মওলানা জিয়াউদ্দিনের মতো ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। কলকাতা আলিয়া মাদরাসার স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত জ্ঞানতাপস, অসাম্প্রদায়িক এবং নীতিজ্ঞ ছিলেন। কিছু দুর্বৃত্ত তাঁকে হেনস্তা করতে উদ্যত হলে তিনি স্বেচ্ছায় কর্মের বন্ধন ছিন্ন করে নির্বাসিত জীবন বেছে নেন। না, একেই আমরা আদর্শ বলছি না। তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলে বিচার চাইতে পারতেন; কিন্তু কে না জানে, বিচারের বাণী চিরকালই নীরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। উদাহরণটি উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হলো প্রকৃত শিক্ষক আত্মসুখে আর পাঁচজনের মতো বেঁচে থাকার জন্য আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করেন না।

সবার জানা, ক্ষমতার দণ্ডের কাছাকাছি না থাকলে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থাকা সহজ নয়। আর ক্ষমতাবানরা চিরকালই তোষামোদপ্রাপ্তির জন্য উন্মুখ। একজন শিক্ষক সব কিছু জেনেও ক্ষমতাধরদের তোষামোদ করলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছোট হন তা-ই নয়, গোটা সমাজ বিনষ্টির পথে ধাবিত হয়।

নির্ভেজাল শিক্ষক রাজকীয় উচ্চপদ থেকে সন্তর্পণে পশ্চাতে থাকতে বেশি আগ্রহী। এখন শিক্ষক নামের কিছু ব্যক্তি নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতার পদলেহনে ব্যস্ত। নিষ্ঠাবান ত্যাগী শিক্ষক দেখে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁদের দৃষ্টিতে এঁরা শিক্ষার কলঙ্ক। তাই শিক্ষকের পদস্খলন হলে অধৈর্য হয়ে পড়েন তাঁরা।

বলা হয়ে থাকে, শিক্ষক মানবসমাজের আলাদা প্রাণী নয়, তবে সাবধানী ও ব্যতিক্রমী। শিক্ষকমণ্ডলীর কেউ কেউ অতিরিক্ত সময় খরচ করে শিক্ষার্থীদের বাড়তি জ্ঞান দান করেন। তাতে তিনি কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখেন। বাড়াবাড়ি হলে অবশ্যই নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য। তাই বলে সমাজে সুনীতি প্রতিষ্ঠার নামে রুই-কাতলাদের আড়ালে রেখে চুনোপুঁটিদের সামনে আনলেই পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে—এমনটি না ভাবাই শ্রেয়।

শিক্ষা বিভাগের কোথাও কোথাও, এমনকি শিক্ষা বোর্ডের অনেকে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে যাচ্ছেন। সেদিকে নজর দেওয়া বোধ করি উত্তম। সমাজের সুনীতিবিরোধী আর মাৎস্যন্যায়ের নায়কদের মেরামতে হাত দিলে শিক্ষকরা যথার্থ শিক্ষক হয়েই থাকতেন, তাঁরা রবীন্দ্রকথিত ‘হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ’ বলে হা-হুতাশ করতেন না।

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038249492645264