শিক্ষা ও অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব এবং করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা ও অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব এবং করণীয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে চীন ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৩ ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের অবস্থা স্থিতিশীল। চীনে ও চীনের বাইরে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ জন করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছে। এর কী রকম প্রভাব পড়বে তা নির্ভর করছে কত দ্রুত এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তার ওপর। এই ভাইরাসের কারণে চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের পুরো প্রভাব মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে এটি পর্যটন, পরিবহন, আন্তর্জাতিক লেনদেন ও শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বুধবার (১১ মার্চ) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ২০০২-০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাসের চেয়েও করোনাভাইরাসের প্রভাব বেশি হবে বলে মনে হয়। কারণ ওই সময় বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল ৮ শতাংশ। এখন তা ১৯ শতাংশ। চীনে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল কয়েক হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এবার করোনায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে। ফলে ২০২০ সালে চীনের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তবে এটি স্পষ্ট যে, এই ভাইরাস শুধু চীনে নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেবে।

করোনার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। কারণ পোশাক খাতসহ অন্যান্য রফতানিজাত পণ্যের কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশ চীন থেকে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে মোট পণ্য আমদানির ২৫ শতাংশ এসেছে। এই ভাইরাসের কারণে চীনের অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় কাঁচামাল শিপমেন্ট হচ্ছে না। আমাদের কারখানাগুলো সাধারণত অল্প কিছু দিনের জন্য কাঁচামাল মজুদ রাখে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে বেশি সময় নিলে মার্চ ও এপ্রিলে পণ্য এবং কাঁচামাল শিপমেন্ট বিলম্বিত কিংবা বাতিল হতে পারে। এরকম হলে এপ্রিলেই তীব্র কাঁচামালের সঙ্কট দেখা দেবে। চীন বাংলাদেশের এক নম্বর বাণিজ্য অংশীদার। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীন ও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা। কিন্তু এখন এ সম্ভাবনা হুমকির মুখে। করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে ৫-৬ মাস পণ্য না এলে রফতানি খাতে আয় প্রায় ১২০০-১৫০০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে (বিজিএপিএমইএ)।
 
চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় বাজারে চীনা পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ড্রিল মেশিন নয়, অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, নিত্য ব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্য যেমন, রসুন, আদা ও দারুচিনির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের প্রতি টনের দাম ছিল ১৩-১৪ হাজার টাকা। এখন এর দাম ১৫ হাজার টাকা। রেস্তরাঁ ব্যবসায়ীদের জন্য চীনের করোনাভাইরাস কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনা প্রক্রিয়াজাত মাশরুম, বেবিকন, সুইটকন, ফায়েল পেপারসহ অন্যান্য খাবারের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে । যেমনÑ ২০০ গ্রাম মাশরুমের দাম ছিল ৬৫ টাকা, এখন ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও চীন থেকে আসা আদা, রসুন, দারুচিনির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রেস্তরাঁ মালিকদের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

পর্যটন ক্ষেত্রটি আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ও সম্ভাবনাময় খাত। মোট জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশী পর্যটকরা যেমন বিদেশে যাচ্ছে অনুরূপ বা বর্ধিত হারে বিদেশী পর্যটক বাংলাদেশে আসে। ফলে করোনার কারণে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা কমে যেতে পারে।

চীনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ আমদানি-রফতানি কমে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে। কারণ ওই দেশগুলো চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। এই অর্থবছরে বিশ্ব অর্থনীতির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনে গাড়ি বিক্রিতে ধস নেমে ৯২ শতাংশ কমেছে (সিপিসিএ)। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সিঙ্গাপুর ও হংকং অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। সঙ্কট মোবাবেলায় সিঙ্গাপুর ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার এবং হংকং ৩৬০ কোটি ডলারের প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ অন্যান্য বেসরকারী বিমান কোম্পানি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এমনকি ভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বৈশ্বিক এয়ারলাইন্সগুলো। যাত্রী প্রায় দুই কোটি বা ১৬.৪ শতাংশ কমেছে (আইকাও)। ফলে বিশ্বব্যাপী বিমান সংস্থাগুলোর মোট অপারেটিং রাজস্ব কমেছে ৫০০ কোটি ডলার। চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নের পথে আছে বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রকল্প। যেমন: পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ঢাকা-আশুলিয়া ফ্লাইওভার, পটুয়াখালী পায়রা তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রসহ ২৭টি প্রকল্প। এগুলো করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন না হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।

বস্ত্র খাতে করোনার প্রভাব অনেক। দেশের বস্ত্রশিল্প ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় চার শ’ সুতার মিল রয়েছে। কিন্তু এসব মিলে সুতার উৎপাদন খরচ বেশি। তাই চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে সুতা আমদানি করতে হয়। করোনার প্রভাবে কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং ঝুঁকিতে আছে গার্মেন্টস শিল্প।

ব্যাংকিং খাতেও করোনার প্রভাব বিরাজমান। কারণ বৈদেশিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে হয়। ঋণপত্র ব্যাংকের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। চীনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ ও অনেক কারখানা বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা এলসি/ঋণপত্র খুলতে আগ্রহী নয়। ফলে ব্যাংক মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে করোনার প্রভাব পড়ছে স্বর্ণের বাজারেও। বর্তমানে ১ ভরি স্বর্ণের দাম ৬১৫২৮ টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। চীনের সব বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি শেষে চলতি সপ্তাহে খোলার কথা ছিল; কিন্তু বাস্তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ বন্ধ রয়েছে। এমনকি পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়ার পূর্বে চীনে প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে চীন সরকার প্রদত্ত বৃত্তিতে ছাত্র ভর্তি বিলম্বিত হতে পারে। সম্প্রতি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করেছেন এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন প্রজেক্ট পেপার উপস্থাপনের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ২০২০ সালে যাদের পিএইচডি ডিগ্রী সম্পন্ন হওয়ার কথা তাদের যথাসময়ে ডিগ্রী ও সনদপত্র না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে চীনে পিএইচডি ও এমএস কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্স সম্পন্ন করতে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করে চীনে ফিরে যেতে নিরৎসাহী হচ্ছেন।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রত্যেক নাগরিকের যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন- যেমন শ্বাসকষ্ট হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা, সংক্রমণ ছড়ায় এমন প্রাণী হতে দূরে অবস্থান করা, মাছ, মাংস, ডিম ভালভাবে সিদ্ধ করে খাওয়া , অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও ভারি কাজ বর্জন করা, হাঁচি-কাশির সময় নাক ঢেকে রাখা, ঠা-া ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকা, যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে বা ভাইরাস বহন করছে তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা, হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা, জনসমাগম পরিহার করে চলা, প্রতিবার সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ডের বেশি সময় নিয়ে হাত ধোয়া, ১৫ মিনিট পর পর পানি পান করা, চোখ, নাক ও মুখ থেকে হাত দূরে রাখা, বাইরে থেকে ফিরে হাত দিয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা, ধূমপান না করা ইত্যাদি।

করোনাভাইরাস যদি দ্রুত সময়ে নিয়ন্ত্রণ না হয় তাহলে বাংলাদেশ সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অন্তত সাময়িকভাবে চীনের বিকল্প উৎস বের করা উচিত। বাংলাদেশের মতো চীননির্ভর অন্যান্য দেশ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে কোন আতঙ্ক তৈরি না হয় এবং যাতে কোন অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে না পারে। বিশ্বনেতারা ও চীন সরকার যৌথভাবে সকল অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ভুলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন এই আমাদের প্রত্যাশা।
 
সর্বোপরি বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যাতে সকল নাগরিক ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে পারে। মানুষকে সতর্ক করার জন্য সরকার ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম চালানো উচিত এবং ভবিষ্যত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সবাইকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

লেখক : মো. শফিকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014857053756714