শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি অসম্ভব। তাই দেশের কিংবা জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রথমেই শিক্ষাখাতে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বিগত ১০ বছরে শিক্ষাখাতে আমাদের অর্জন ব্যাপক। যা আমাদের Sustainble Development Goal অর্জনে সহায়ক। বিশ্ব ব্যাংক , ইউনেস্কো, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ আন্তর্জাতিক দাতা ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতিকে অন্যদের জন্য উদাহরণ বলে অভিহিত করেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইউহানেস জাট বলেছেন, শ্রমশক্তিতে তারুণ্যের প্রাধান্য বাড়ায় আগামী ১০ বছরে বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। তাই এখন থেকেই একটি সুপরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই শ্রমশক্তিকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
বিগত ১০ বছরে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। সব থেকে বড় যে ব্যাপারটি তা হলো আমাদের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সেশনজট দূর হয়েছে। আগে যেখানে অনার্স শেষ করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ৬-৭ বছর লেগে যেত সেখানে এখন প্রায় দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে নির্ধারিত ৪ বছরেই অনার্স শেষ করা যায়। এতে করে শিক্ষার্থীরা এক দিকে যেমন হতাশা থেকে মুক্তি পেয়েছে তেমনি ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য পাচ্ছে পর্যাপ্ত সময়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের আর একটি বড় অর্জন হচ্ছে বিনামূল্যে বই বিতরণ। ২০১০-২০১৬ সালে প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বছরের প্রথম দিনে ১৮৯ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। এ বছরও ১ জানুয়ারি ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই। বিশ্বের কোনো দেশে এত বই বিনামূল্যে বিতরণের রেকর্ড নেই । পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত । বহু বছরের মুখস্থ বিদ্যার শৃঙ্খল থেকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুক্ত করার জন্য এটি ছিল একটি যথার্থ সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের পরিসংখ্যান অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভেতরে বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে। যা আমাদের জন্য খুবই সম্মানের। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৪৯ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর ৫০.৩৯ % এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫২ % শিক্ষার্থী ছাত্রী। এর পাশাপাশি কোচিং বাণিজ্য বন্ধে বর্তমান সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২ প্রণয়ন করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন, স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে আমাদের মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও আধুনিক করবে। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ প্রণয়ন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে পাশের নীতি থেকে সরে এসেছে বলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এত উন্নয়ন সত্ত্বেও আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলাম প্রশ্ন ফাঁস নামক এক ব্যাধির কারণে। কিছু অসত্ চক্র,অভিভাবক ও কোচিং সেন্টার আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এই অপকর্মটি করে আসছিল। কিন্তু বিগত বেশ কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষা কোনো রকম প্রশ্ন ফাঁস ছাড়া সম্পন্ন হওয়ায় সাধারণ সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। বর্তমানে বেশ কিছু পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই অনিয়মের কথা শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার কেন্দ্রস্থল তাই এখানে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি যতই স্বচ্ছ ও নিয়মের মধ্যে হবে দেশের জন্য ততই মঙ্গল। পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেটের আরও বেশি অংশ বরাদ্দ দেওয়া যায় কিনা সেটি ভেবে দেখার সময় এসেছে। গবেষণার জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে মনে করি। আমাদের বাজেটের প্রায় ১৪-১৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয় যেখানে অর্থনীতিতে প্রায় আমাদের সমপর্যায়ের দেশগুলো তাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। বিগত ১০ বছরের মতো সামনের দিনগুলোতেও শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারলে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। কারণ পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। যেদিন যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ এবং উন্নত গবেষণার মাধ্যমে আমরা একটি শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হব, সেদিনই আমরা পাব একটি উন্নত দেশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: ইত্তেফাক