শিক্ষা ক্যাডারের চেইন অব কমান্ড কি ভেঙ্গে পড়বে? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা ক্যাডারের চেইন অব কমান্ড কি ভেঙ্গে পড়বে?

মাছুম বিল্লাহ |

  
জুনিয়রকে সিনিয়র পদে পদায়নে বেসরকারি সংস্থাগুলো এবং এনজিওগুলো তো চ্যাম্পিয়ন! যদি কোনো প্রার্থী বা প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির বা পরিচিত কারো আত্মীয়-স্বজন হয় আর যদি দু-চার লাইন ইংরেজি বলতে পারে, তাহলে আর কথা নেই। সব নিয়ম-নীতি, কালা-কানুন ভঙ্গ করে তাকে কোনো একটি বিভাগের প্রধান চেয়ার বসিয়ে দেয়া হয়। যে বিভাগে তাকে বসিয়ে দেয়া হলো সে সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আছে কিনা, হে ওই কাজের পূর্ব ইতিহাস বা বর্তমান পরিস্থিতি জানে কিনা, তার কনটেন্ট সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে কিনা এগুলো কিছু বিচার বিবেচনা না করে যে বা যারা বছরের পর বছর শ্রম, মেধা, ধৈর্য একাগ্রতা, ডেডিকেশন দিয়ে ওই বিভাগটি গড়ে তুলেছেন তাদের কোনো মূল্যায়ন না করে কাত করে ইংরেজি বলা কিংবা উল্টাপাল্টা করে চুল ছাঁটা বা বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে একটি সার্টিফিকেট বাগিয়ে আনা ছেলে বা মেয়েটিকে সবার উপরে বসিয়ে দেওয়া হয়। এটি হচ্ছে এনজিও কালচার, কর্পোরেট কালচারে নাকি এটি হচ্ছে। ফলে অবস্থা যা হওয়ার তাই হয়! সে তার মতো কয়েক দিন সবাইকে নাচিয়ে কাজের বা বিভাগের বারোটা বাজিয়ে বিদায় হন। 

কিন্তু সরকারি বিভাগে তো এই কালচার থাকতে পারে না। এটি হতে হবে যৌক্তিক, স্থায়ী ও অনুকরণীয় একটি মডেল। এখানে সিনিয়রদের টপকিয়ে যাদের পদায়ন করা হয় তারাও স্থায়ী কোনো মানসিক শান্তি পান না, সাময়িক একটু তৃপ্তির ঢেকুর হয়তো তুলতে পারেন। কিন্তু নিয়মকে সবার জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য টিকিয়ে রাখতে হয়। তাতে সবারই উপকার। আর সরকার সেটি ইচ্ছা করলেই পারে। সরকার অস্থায়ী কোনো বডি নয়, সরকার এনজিওর মতো হঠাৎ চমক দিয়ে কাজ করার কোনো সংগঠন নয়। এটি জনগণের এবং দেশের একটি বডি, দেশের সংগঠন এখানে যা কিছু হবে হা হতে হবে সর্বজনীন। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা পার্টির স্বার্থে হওয়া উচিত নয়। দুঃখজনক বিষয় হলো হচ্ছে কিন্তু তাই।

স্বাধীনতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সংসদের নেতারা বলেন, মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ শীর্ষপদে যারা আসীন আছেন তারা বর্তমানে চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা। তাদের গ্রেডেশন বা জ্যেষ্ঠতা এতই নিচে যে, সরকার ৫০ শতাংশ অধ্যাপককে তৃতীয় গ্রেড দিলেও তারা এটা পাবেন না। ফলে, এত জুনিয়র কর্মকর্তাকে উর্ধ্বতন পদে পদায়ন করায় সিনিয়রদের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ১ এপ্রিল দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হয়, নতুন বদলি ও পদায়নে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত একটি সিন্ডিকেট শিক্ষা প্রশাসনে আবার পুর্নবাসন পেল। এই সিন্ডিকেটের নেতা সাবেক এক মন্ত্রীর একান্ত সচিব। তারা বলছেন, এই এপিএস শিক্ষা ক্যাডারে ছিলেন। তিনি শিক্ষা ক্যাডারের বদলি ও পদায়ন করতে গড়ে তুলেছিলেন এক সিন্ডিকেট। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় ওই এপিএসকে সরিয়ে দেয়া হয়। সাবেক ওই এপিএস এখন আবার তার সিন্ডিকেট শক্তিশালী করেছেন। তার পছন্দের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে এবং হচ্ছে। গত ২৪ মার্চ এক আদেশে ২৬ জনকে পদায়ন ও পৃথক আদেশে রেকর্ড সংখ্যক ১৮ জনকে একযোগে ওএসডি করা হয়। একই দিন আলাদা এক আদেশে ২৬ জনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মাউশিতে চাকরি করে আসা অনেক কর্মকর্তাকেও এবার বদলি করা হয়নি। অথচ বদলি করা হয়েছে তিন বছরও হয়নি এমন কর্মকর্তাদের। অনেক কর্মকর্তা পাঁচ থেকে বারো বছর পর্যন্ত ঢাকায় আছেন তাদের বদলি বা ওএসডি করা হয়নি।
 
সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলির গোড়ায়ই একটি বিশাল গলদ রয়ে গেছে। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের পাবলিকেশন্স, চাকরির জ্যেষ্ঠতা, একাডেমিক পারফরম্যান্স, বাৎসরিক প্রতিবেদন, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ও বিভাগীয় পরীক্ষাসহ বেশ কিছু ক্রাইটেরিয়ার ওপর ভিত্তি করে পদোন্নতি হওয়া উচিত।

এটি ঢালাওভাবে বা শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় হওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। হ্যাঁ, সাময়িকভাবে তাদের এটি ভালো লাগার কথা; কিন্তু আখেরে এর ফল যে ভালো হয় না তার প্রমাণ সব জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যখন কারো পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয় তখন আর কারো খুব একটা প্রশ্ন থাকে না। এই সমালোচনা তখন নব্বই থেকে দশ শতাংশ বা তারও নিচে নেমে আসে। আর তা না হলে সারাজীবনই এই সমালোচনা চলতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষা বিভাগের উন্নয়ন তো দূরের কথা, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চলাতেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এখন হচ্ছেও তাই। 

শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদেও সহকারী অধ্যাপক, পরে সহযোগী অধ্যাপক পদের শিক্ষকদের বসানোর অভিযোগ ও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পদটি যদিও সিনিয়র অধ্যাপক পদের সমমানের। এটি করা হয়েছে খুঁটির জোরে, রাজনীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে। শিক্ষা বিভাগের এসব থাকা উচিত কী? সাময়িক লাভের আশায় অনেকেই এসব নিয়ে কথা বলেন না, চুপ করে থাকেন নিজের পদটি বাগানোর জন্য। এসব বিশাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে চান না অনেকেই। কিন্তু নিজের ঘাড়ে যখন আসে, তখন কেউ কেউ কথা বলেন। এটি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই বলা উচিত তাদের সম্মিলিত স্বার্থের কারণে। 

আর একটি বিষয় হচ্ছে শিক্ষকতা বাদ দিয়ে প্রায় অনেকেই শিক্ষা প্রশাসনে আসতে আগ্রহী, উদগ্রীব এবং মুখিয়ে থাকেন। তাহলে শিক্ষার কী হবে, শ্রেণিকক্ষের কী হবে? শিক্ষার্থীদের কী হবে? শিক্ষাদানকে আনন্দদায়ক করার কথা বলা হচ্ছে। কে করবে সেটি, সবাই যখন শিক্ষাদানকে অপছন্দ করে প্রশাসনে আসতে চান? তাই শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদটি হতে হবে সিনিয়র অধ্যাপক, যাঁর জন্য থাকবে রাষ্ট্রীয় বিশেষ সম্মান। প্রশাসনে যারা আসবেন তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য-সেটি তিন বা চার বছর হতে পারে। আবার শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যাবেন। এই নিয়মটি কাগজে-কলমে ও বাস্তবে পালন করা হলে শিক্ষা বিভাগে এত ঝামেলা থাকার কথা নয়। বছরের পর বছর কেন একজন শিক্ষক কর্মকর্তা পদে আসীন থাকবেন? শিক্ষকদের এবং শিক্ষক নেতাদেরই তো এই কথা বলা উচিত, দেশের স্বার্থে, শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এবং সর্বোপরি দেশের সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থাপনার স্বার্থে; বিষয়টির সমাধান হওয়া উচিত।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ক্যাডেট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057010650634766