একদা কলেজপর্যায়ে পঠন-পাঠনে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। সুতরাং শিক্ষা ও শিক্ষকতার অর্জন ও অপচয়ের দিকটি সম্পর্কে আংশিক ধারণা আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত তেমন নেই বললেই চলে। তবে নিজের পড়া এবং পুত্র-পৌত্রাদির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত দেখে আসছি। ধন্দ লাগে, আমাদের অগ্রগতি কতদূর! মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, প্রাথমিকে পড়ার সময় আমাদের স্মরণীয় শিক্ষকদের বেশির ভাগ ম্যাট্রিকুলেশন বা এনট্রান্স পাস ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন নন-ম্যাট্রিক। কদাচিৎ দু-একজন . G.T । তাঁরা ভাষা ও গণিতের যে ভিত গড়ে দিতেন, আজকের দিনে তা অনেকটা রূপকথার মতো। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ওয়ারি শিক্ষক ছিলেন না বললেই চলে। একজন শিক্ষক সমানতালে বাংলা-ইংরেজি, গণিত-ভূগোল-ইতিহাস দক্ষতার সঙ্গে পড়াতেন। তখন বিস্মিত হতাম শিক্ষকের মেধার বিচিত্র বিচ্ছুরণ প্রত্যক্ষ করে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে কি ঘোরে না, সে বিষয়ে সংশয়ের কিছু শিক্ষক ছিলেন না তা নয়, তবে তাঁদের আন্তরিকতার অভাব লক্ষ করা যায়নি। এখন দেখছি, গোড়া থেকেই বিষয়ওয়ারি শিক্ষক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এঁদের কেউ কেউ শিক্ষক নামের বিপরীত শব্দ। তাঁরা গাইডনির্ভর। মূল পুস্তকের সঙ্গে সম্পর্কহীন। গাইড কিনতে হয় না। কম্পানি বিনা পয়সায় দিয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে এক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একই ধারা। তাই তো দেখা যায়, শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় ক্লাস-প্র্যাকটিক্যাল করে না। শুধু গাইড পড়ে পরীক্ষায় অংশ নেয়। ইন হাস্ত শিক্ষা নম্। যেসব শিক্ষার্থী ভালো করে, তারা নিজেদের মেধাগুণে। আজকের দিনের কিছু শিক্ষকের শিক্ষাদানে অবদান কতটুকু তা গবেষণার বিষয়। কারণ শিক্ষকতায় আমিসহ যারা জীবিকার পথ করে নিয়েছি, তারা তুলনামূলকভাবে দুর্বল মেধার মানুষ। নিজের কথা দিয়ে বলি, উচ্চ মাধ্যমিকে মেধাবৃত্তি প্রাপ্ত কুড়িজনের মধ্যে আমরা তিনজন ছাড়া অন্যরা শিক্ষকতায় আসেননি। এই তিনজনের মধ্যে আমি দুর্বলতম এ জন্য যে অন্য কোনো পেশায় প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলাম। দেখেছি আমাদের মাঝে কী ভয়াবহ শূন্যতা। এদের মধ্যে কেউ অ্যাড্হককে হক করা, আবার অনেকে আত্মীয়তার পর্যায়ের। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে ভাবছি, শিক্ষা নিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া আমার উচিত হয়নি। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এই অনুশোচনাবোধ প্রকারান্তরে দাম্ভিকতার নামান্তর। তা ভাবতে পারেন, ভাবনার তো পরিসীমা নেই! এতদসত্ত্বেও আমরা উচ্চারণ করব, ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল মেধার। মেধা বিধিদত্ত, তা নিয়ে অনুযোগ কিংবা গর্ব করার কিছু নেই। তবে কোনো বিষয় নিয়ে পুনঃপুনঃ অনুশীলন করলে তার গভীরে প্রবেশ করা যায়। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য আমরা শিক্ষক সমাজ অধরা কর্মসংস্থান সুলভে পেয়ে বই খুলতে চাই না। ফলে মেধাকর্ষণ হয় না। তবু সন্তানাদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হয়। ভর্তির পর সংগতি থাকলে গৃহশিক্ষক অথবা ভালো ফলের দুরাশায় শিক্ষাবিক্রির দোকানে পাঠাই। মিষ্টি বিতরণের মতো ফলও হয় অনেকের। কারণ গাইডনির্ভর প্রশ্নপত্র আর উত্তরপত্র মূল্যায়নের নীতিহীনতায় কোনো বাধা থাকে না। শেষ পর্যন্ত উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি হতে গিয়ে বাধা পায়। তখন কেঁচেগণ্ডূষ করেও পার পাওয়া যায় না। বেসরকারিতে ধাবিত হতে হয়। এতে ডিগ্রি পায়। শেখে না। অনেকে মনে করেন অপরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, পঠন-পাঠনে ঘন ঘন পদ্ধতি পরিবর্তন আর একাধিক পরীক্ষার বোঝা বিপন্নতা ডেকে আনছে।
আমরা ভবিষ্যৎ না ভেবে, প্রজন্মকে অক্ষম করার তালে পদ্ধতি বদলাতে ব্যস্ত! যা শিক্ষার্থীর তেমন উপকারে আসে না। দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চ সনদ সংগ্রহ করে ইংরেজি দূরে থাক বাংলা ভাষায়ও শুদ্ধ দরখাস্ত লিখতে পারে না।
শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় প্রবেশের শর্ত হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রি আবশ্যিক হিসেবে ধরা হচ্ছে। তাই দিয়ে মেধা ও যোগ্যতার পরিমাপ কঠিন। কারণ ঘরে ঘরে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সনদ বেচার দোকান হিসেবেই সেগুলো গণ্য হতে চলেছে। আর পিএইচডি এখন পয়সা দিলে অনায়াসে পাওয়া যায়। অনেকে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে ডিগ্রি আয়ত্তে আনেন। সুতরাং পিএইচডি মেধার মাপকাঠি নয়। দেখা গেছে অনেকে পিএইচডির পর আর কখনো এককলম লেখতে পারেননি। মেধা কেনার বিষয় নয়। তা বিধিদত্ত।
লেখক : গোলাম কবির, সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ।