শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান: কেউ স্বস্তিতে কেউ আতঙ্কে - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান: কেউ স্বস্তিতে কেউ আতঙ্কে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে একপক্ষে স্বস্তি, অন্যপক্ষে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্কুল-কলেজের ভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানাসহ বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে স্বস্তি অনুভব করছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে দুদকের কঠোর অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুদকের কয়েকটি অভিযানে কোচিংবাজ, অসাধু শিক্ষক ও পরিষদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুদকের কঠোর অবস্থানের কারণে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি বাণিজ্য অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

রাজধানীর একটি শীর্ষস্থানীয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা ও নমনীয়তা ছাড়া স্কুল-কলেজে দুর্নীতি হতে পারে না। যাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে দুর্নীতি হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেই আগে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ। আর পরিচালনায় থাকেন গভর্নিং বডি। তারা সৎ ও কঠোর অবস্থানে থাকলে সাধারণ শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য ত্যাগ করে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করতে বাধ্য হন। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের অভিযোগ ওঠে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকার সমর্থক ‘স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ’ (স্বাশিপ)-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘দুদকের অভিযানে দুর্নীতি কমছে- এটা ঠিক, আমি এই কার্যক্রমকে সমর্থন করি। আবার সাধারণ শিক্ষকরা খুবই আতঙ্কে রয়েছেন, যা চিন্তার বিষয়। শিক্ষকরা আতঙ্কে থাকলে পাঠদান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ তারা ছোট ছোট ভুল-ত্রুটি করে বড় শাস্তির মুখে পড়ছেন; কিন্তু গভর্নিং বর্ডি ও বিতর্কিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বড় শিক্ষা ব্যবসায়ী ও রাঘব বোয়ালদের শাস্তির আওতায় আনা হলে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি এমনিতেই কমে যেত।’

এদিকে অভিভাবক, দুদক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার চাপের মুখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি রোধে ক্ষেত্র বিশেষ কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষা প্রশাসন। কিন্তু রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যনির্ভর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবারই নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতি করেও শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ মহলের সহযোগিতায় পার পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষক ৮-১০ বছর একই স্টেশনে বহাল থেকে দুর্নীতি, অনিয়ম, ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছেন শিক্ষক নেতারা।

সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও রাজধানীর শহীদ শেখ রাসেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইনছান আলী  বলেন, ‘যখন-তখন অভিযান পরিচালনার কারণে শিক্ষকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে। আতঙ্কিত শিক্ষকদের পক্ষে স্বাভাবিক পাঠদান সম্ভব নাও হতে পারে। তবে যেসব শিক্ষক ৮-১০ বছর ধরে ঘুরেফিরে রাজধানীতেই বহাল রয়েছেন তাদের বদলির আওতায় আনা হলে দুর্নীতি, ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্যের সিন্ডিকেট এমনিতেই ভেঙে যেত।’

এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল করিম বলেন, ‘অপরাধ ছোট-বড় যাই হোক তা যে করবে সেই অপরাধী। ছোট অপরাধীর পাশাপাশি বড় অপরাধীদেরও ধরতে হবে। তবে দুদকের অভিযান নিয়ে আতঙ্কের কোন কারণ নেই। নিরপরাধ শিক্ষকদের তো দুদক ধরছে না। তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই অভিযান পরিচালনা করছে। আমি দুদকের অভিযানকে স্বাগত জানাই।’

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান

শিক্ষার্থী ভর্তিতে নেয়া অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দিতে রাজধানীর ৩টি স্কুলকে গত ২৮ জানুয়ারি নোটিশ দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।

স্কুল ৩টি হলো- কাকলী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগের তদন্ত শেষে সত্যতা পাওয়ার পর এ নোটিশ দেয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।

একই দিনে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরজাহান হামিদাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশে নূরজাহান হামিদাকে সাময়িক বরখাস্ত করে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

২৮ জানুয়ারি হটলাইন ১০৬-এ অভিযোগ পেয়ে ওই বিদ্যালয়ে অভিযান চালায় দুদকের একটি টিম। অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক নূরজাহান হামিদা শিক্ষার্থী ভর্তির সময় বিনা রশিদে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা করে আদায় করেছেন। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের বিনামূল্যে ভর্তির নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে, এ বছর ভর্তি বাবদ প্রধান শিক্ষক অবৈধভাবে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আয় করেছেন।

দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক মুনীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুদক শিক্ষা সেক্টরে দুর্নীতির শেকড় উৎপাটনে কঠোর থাকবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদেরও প্রতিরোধমূলক মানসিকতা থাকতে হবে।’

গোপন অভিযোগ পেয়ে গত ২৭ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ চট্টগ্রামের তিনটি স্কুলে আকস্মিক পরিদর্শন করেন। একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি সেখানকার আট শিক্ষকের সাতজনকেই কর্মস্থলে পাননি।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে কাউকেই ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। যেকোনো মূল্যে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে দুদক দ-বিধির ১৬৬ ধারা প্রয়োগ করবে। তারপরও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষতিসাধন করবেন বা করার চেষ্টা করবেন এমন কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’

দুদক জানায়, দুদক চেয়ারম্যানের কাছে বিশেষ মাধ্যমে খবর আসে চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে আসেন না। বিষয়টি গোপন রেখে দুদক চেয়ারম্যান সকালে চট্টগ্রামে যান। সকাল সোয়া ৯টায় নগরীর কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে দেখেন, স্কুলের আটজন শিক্ষকের মধ্যে একমাত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক উপস্থিত। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আশপাশে আচার-চানাচুর খেয়ে অলস সময় পার করছে। এ সময় অভিভাবকগণ দুদক চেয়ারম্যানকে কাছে পেয়ে তাদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন।

এর পর পরই দুদক চেয়ারম্যান নগরীর ভাটিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেন ১১ জন শিক্ষকের মধ্যে দুজন শিক্ষক অনুপস্থিত। এদের অনুপস্থিতির কারণ স্কুল কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি। দুদক চেয়ারম্যান ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি শিট পরীক্ষা করে দেখেন, গতকাল যেসব শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল তাদের অনেককেই উপস্থিত দেখানো হয়েছে। আবার আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের রোল কল করা হয়নি। এ বিষয়েও স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

সর্বশেষ দুদক চেয়ারম্যান নগরীর শীতলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন, টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা কোনো শিক্ষার্থীকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় সুযোগ দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ সময় সন্তোষ প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যান। তবে নবম শ্রেণীতে এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের ২০০০ টাকার বিনিময়ে দশম শ্রেণীতে প্রোমোশন দেয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘এটা অনৈতিক। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনৈতিকতার কোনো স্থান থাকতে পারে না।’

গত ১৬ জানুয়ারি অবৈধ ভর্তির খবরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অভিযানে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি টিম। এরপর আরও দু’দফা ওই প্রতিষ্ঠানে অভিযানে যায় দুদক টিম। তবে ভর্তি সংক্রান্ত কোনো অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দুদক থেকে জানানো হয়। সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ পায় দুদক; পরে সংস্থার একটি দল ওই স্কুলেও অভিযান চালায়।

এছাড়া কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ পেয়ে গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। অভিযানের সময় স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ ৩০ জন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুধু কোচিংবাজ নয়, যারা এই প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করছে তাদের বিরুদ্ধেও দুদকের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কয়েকজন শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের একটি পক্ষ সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করছে।’

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045859813690186