ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হয় শিক্ষা আর শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হয় জ্ঞান। এ জন্যই ভাষার ব্যবহার যথাযথ না হলে শিক্ষা যেমন ত্রুটিপূর্ণ হয়, জ্ঞানও তেমনই হয়ে ওঠে অপূর্ণ। আজকে আমরা দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি :
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে ত্রুটি: বাংলাদেশে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর বেশ কিছু নামেরই সমস্যা আছে। প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়। 'বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি'র (বুয়েট) বাংলা নাম 'বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়'। ইংরেজি নামের 'অ্যান্ড টেকনোলজি' অংশটুকু বাংলা নামে না থাকায় বাংলা নাম ত্রুটিপূর্ণ। এটির বাঞ্ছনীয় নাম হলো 'বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়'। 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাতীয় মর্যাদায় (ন্যাশনাল স্ট্যাটাস) অভিষিক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সেহেতু এটির নাম যথার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে না।
এটির যে দায়িত্ব, তাতে এর 'অধিভুক্তিকারী বিশ্ববিদ্যালয়' (অ্যাফিলিয়েটিং ইউনিভার্সিটি) বা এই জাতীয় কোনো নাম হওয়া কাম্য ছিল। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়' নামটি উদ্ভট। কারণ এখানে বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ ঘটে গেছে। বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ নাম ব্যবহার না করাটাও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মান প্রদর্শক। কাম্য ছিল 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়', ইংরেজিতে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল ইউনিভার্সিটি'। নামটি বড় হয়ে যাচ্ছে মনে করা হলে হতে পারত 'বঙ্গবন্ধু চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়', ইংরেজিতে 'বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটি'। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগুলোর দিকে তাকালে প্রচণ্ড হতাশ হতে হয়। বাংলা রাষ্ট্রভাষার এই দেশে একমাত্র 'গণ বিশ্ববিদ্যালয়' ছাড়া সবক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই ইংরেজিতে। বেশ কয়েকটির মধ্যে থাকা 'ইন্টারন্যাশনাল' শব্দের ব্যবহার যথাযথ নয়। 'ইউনিভার্সিটি' শব্দেই 'বিশ্ব' ধারণাটি থাকায় 'ইন্টারন্যাশনাল' শব্দটির ব্যবহার পুনরুক্তি এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এ যেন যানবাহনে লেখা 'বিরতিহীন'-এর আগে 'সম্পূর্ণ' লেখার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে 'ওয়ার্ল্ড' থাকাও প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে 'সাইন্স' থাকলে বাংলায় তা 'সায়েন্স' বানানে লেখাও অনাকাঙ্ক্ষিত। দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেও বাংলার মধ্যে ইংরেজি ঢুকে পড়েছে, যদিও এগুলোর পূর্ণ বাংলা নামই কাঙ্ক্ষিত ছিল।
এ জন্যই 'চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়' এবং 'বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়' হতে পারত যথাক্রমে 'বাংলাদেশ পশুরোগ ও পশুবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়' এবং 'বাংলাদেশ বস্ত্র প্রস্তুতি বিশ্ববিদ্যালয়'। সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম 'বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস', যার কোনো বাংলা নেই। এটির কাঙ্ক্ষিত নাম হতে পারত 'বাংলাদেশ পেশাজীবী বিশ্ববিদ্যালয়'। বস্তুত প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে একটিই; কিন্তু তা হতে পারে দুই ভাষায় :একটি বাংলায়, অন্যটি ইংরেজিতে। এবার মহাবিদ্যালয়ের নাম। এগুলো দুই রকম :সরকারি ও বেসরকারি। প্রতিষ্ঠান সরকারি হলেও নামের মধ্যে শব্দটি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। 'ঢাকা কলেজ'-এর আদলে 'সরকারি' শব্দটি বর্জন করে বাঞ্ছনীয় 'কবি নজরুল কলেজ' হওয়া। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি নয়, সেগুলোর নামের মধ্যে কি তাহলে 'বেসরকারি' শব্দটি ঢুকিয়ে দিতে হবে? তাহলে কি লিখতে হবে: 'নর্থ সাউথ ননগভর্নমেন্ট ইউনিভার্সিটি', 'ঢাকা বেসরকারি সিটি কলেজ', 'বেসরকারি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ'? কোনো কোনোটির নামের মধ্যে 'মহিলা' শব্দটি সংযুক্ত আছে। 'মহল' থেকে 'মহিলা' শব্দটি আসায় 'মহিলা কলেজ' সম্মানজনক নয়। এ ক্ষেত্রে হতে পারত 'নারী' শব্দটির প্রয়োগ। মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ এবং নার্সিং কলেজগুলোর সবক'টির নামই ইংরেজিতে। এগুলোর কাঙ্ক্ষিত নাম হতে পারত যথাক্রমে 'চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়', 'দন্ত্য মহাবিদ্যালয়' এবং 'সেবা মহাবিদ্যালয়'। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে 'ল' কলেজ' শব্দজোড় আছে, সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত নাম 'আইন মহাবিদ্যালয়'। প্রতিষ্ঠানের নামের বানান নিয়েও কিছু বলা প্রয়োজন। যেসব বানান পুরনো, সেগুলো বর্জন করে বাংলা একাডেমি-প্রবর্তিত বানানবিধি অনুসরণ করাই বাঞ্ছনীয়।
ডিগ্রি নিয়ে সমস্যা: উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষালাভকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সার্টিফিকেট লাভ করেন, তা-ই ডিগ্রি। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান ডিগ্রিদানের অধিকারী নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কোনো সার্টিফিকেট প্রদান করে, তা শুধুই সার্টিফিকেট, ডিগ্রি নয়। ডিগ্রি চারটি :স্নাতক (বিএ, বিএসসি, বিবিএ, এমবিবিএস, বিডিএস ইত্যাদি), স্নাতকোত্তর (এমএ, এমএসসি, এমএসএস, এমডি, এমএস ইত্যাদি), এমফিল, পিএইচডি। অনেক সময় মানুষের মুখ থেকে শোনা যায়, পত্রিকার পাতায়ও দেখা যায় :'এফসিপিএস ডিগ্রি', 'এমসিপিএস ডিগ্রি', 'ব্যারিস্টারি ডিগ্রি', 'ডিপ্লোমা ডিগ্রি' ইত্যাদি। আসলে এফসিপিএস, এমসিপিএস, ব্যারিস্টারির কোনোটিই ডিগ্রি নয়। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা ওই প্রতিষ্ঠানের ফেলো (সম্মানিত সদস্য) বা মেম্বার (সদস্য) হন, তাদেরকেই বলে যথাক্রমে 'এফসিপিএস' ও 'এমসিপিএস'। 'এফসিপিএস' ও 'এমসিপিএস' শব্দ দুটিও (এগুলো শব্দের মতোই ব্যবহূত হয়) এক বিচারে ত্রুটিপূর্ণ। 'এফসিপিএস' 'ফেলো অব দ্য কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস' হলেও কলেজের নাম যেহেতু 'বিসিপিএস' (বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস), সেহেতু 'এফসিপিএস' এবং 'এমসিপিএস'-এর বদলে বাঞ্ছনীয় ছিল 'এফবিসিপিএস' ও 'এমবিসিপিএস'।
এমনটি না হওয়ায় এফসিপিএস এবং এমসিপিএসরা আত্মপরিচয়ের সমস্যাকীর্ণ। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এবং রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে হওয়া এফআরসিপি, এমআরসিপি, এফআরসিএস ইত্যাদি কিন্তু ঠিকই আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হলো এমডি ও এমএস। মাস্টার অব সার্জারি হওয়ায় 'এমএস' নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু 'এমডি' 'ডক্টর অব মেডিসিন' হওয়ায় ভুলক্রমে এটিকে 'পিএইচডি' সমপর্যায়ের ভাবার অবকাশ রয়েছে। এটি 'এমডি' না হয়ে 'এমএম' (মাস্টার অব মেডিসিন) হলেই ভালো হতো। 'ব্যারিস্টারি' কোনো ডিগ্রি নয়। 'ব্যারিস্টার' হলেন তারাই, যারা ইংল্যান্ডের বার কাউন্সিল থেকে সনদ লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার কাউন্সিল থেকে যারা সনদপ্রাপ্ত হন, তাদেরকে বলে 'অ্যাটর্নি', আর বাংলাদেশ থেকে যারা সনদপ্রাপ্ত হন, তাদেরকে বলে 'অ্যাডভোকেট'। বস্তুত বাংলাদেশের আদালতে যারা ওকালতি করেন, তাদের সবারই 'অ্যাডভোকেট' নামে অভিহিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। 'ডিপ্লোমা' এক অথবা একাধিক বছরের কোর্স হলেও যেহেতু এটি স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সমপর্যায়ের কিছু নয়, সেহেতু একে 'ডিপোমা ডিগ্রি' বলা ভুল।
অনুষদের (ফ্যাকাল্টি) নামেই সাধারণত ডিগ্রি হয়। কলা (আর্টস) অনুষদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলা, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে পাস করলে ডিগ্রি হয় বিএ ও এমএ; বিজ্ঞান (সাইন্স) অনুষদভুক্ত গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে পাস করলে ডিগ্রি হয় বিএসসি ও এমএসসি; সামাজিকবিজ্ঞান (সোশ্যাল সাইন্স) অনুষদভুক্ত অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে পাস করলে ডিগ্রি হয় বিএসএস ও এমএসএস। এ দেশে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদের নাম 'কলা' না রেখে রাখা হয়েছে 'মানবিকীবিদ্যা' (হিউম্যানিটিজ)। এগুলোতে কলা অনুষদ না থাকায় প্রদত্ত ডিগ্রির নাম কীভাবে 'বিএ', 'এমএ' হয়, বোধগম্য নয়। অনুষদের নাম 'হিউম্যানিটিজ' (ইংরেজিতে) হওয়ায় ডিগ্রি হওয়ার কথা 'বিএইচ' (ব্যাচেলর অব হিউম্যানিটিজ), 'এমএইচ' (মাস্টার অব হিউম্যানিটিজ)। একইভাবে বলা যায়, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদের নাম 'ব্যবসায় প্রশাসন' (বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) নয়, তাদের ডিগ্রিও 'বিবিএ', 'এমবিএ' হওয়া প্রশ্নবিদ্ধ। অনুষদের নাম 'ব্যবসায় শিক্ষা' (বিজনেস স্টাডিজ) হলে ডিগ্রি হওয়া উচিত 'বিবিএস', 'এমবিএস'।
সম্প্রতি কয়েকটি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে বিষয়ের নামে। যেমন : 'এমবিএম' (মাস্টার অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট), 'এমডিএস' (মাস্টার অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ) ইত্যাদি। এগুলো নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। কয়েক বছর ধরে বাজারের দিকে তাকিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি ডিগ্রি 'ইএমবিএ' (ইভনিং এমবিএ)। সন্ধ্যাকালীন শিক্ষা কোর্স হলে যদি 'ইএমবিএ' হয়, তাহলে সকালের জন্য 'এমএমবিএ' (মর্নিং হিসেবে), দুপুরের জন্য 'এনএমবিএ' (নুন হিসেবে), বিকেলের জন্য 'এএমবিএ' (আফটারনুন হিসেবে) প্রবর্তন করতে হবে নাকি? কার মাথা থেকে যে এমন উদ্ভট চিন্তা আসে? যাদের বা যখনই পড়ানো হোক না কেন, ডিগ্রি 'এমবিএ'ই। বিকেলে বা রাতে ক্লাস হয় বলে কি ডিগ্রি 'এএলএলবি' (আফটারনুন হিসেবে) বা 'এনএলএলবি' (নাইট হিসেবে) দিতে হবে নাকি? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 'ডিবিএ' (ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) নামে একটি গবেষণা ডিগ্রি চালু করেছে।
ডিবিএধারীরা কি নামের গোড়ায় 'ড.' লিখবেন? তাহলে 'পিএইচডি'র সঙ্গে 'ডিবিএ'র পার্থক্য কোথায় থাকল? 'ডিবিএ' হলে 'ডিএ' (ডক্টর অব আর্টস), 'ডিএসএস' (ডক্টর অব সোশ্যাল সাইন্স) প্রবর্তনেই-বা বিলম্ব কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু এ দেশের অবিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বপ্রাচীন, সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু আমরা অচিরাৎ ধারণা করছি, এ আদর্শ ও ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও পঙ্গপালের মতো এমন ডিগ্রি প্রদানে ঝাঁপিয়ে পড়বে? পিএইচডির শর্তের ঘাটতি থাকলে ডক্টরেটের খায়েশ কেন, আমরা বুঝতে নাচার। চিন্তার কি নিদারুণ দারিদ্র্য। ডিবিএ অব্যাহত রাখা উচিত কিনা, দ্রুত তার পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। যে কোনো ধরনের ভুলের মধ্যে বসবাসই অসুস্থতার পরিচয়বাহক।
লেখক: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: সমকাল