শিক্ষা বিভাগের 'অবকাশমুক্তি' হোক - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা বিভাগের 'অবকাশমুক্তি' হোক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের নয়, একটি উন্নত-সমৃদ্ধ-সুখী বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখেছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।' বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তা ও আদর্শের আলোকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সুযোগ বেশিদিন পাননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ২০২১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞাননির্ভর ও প্রযুক্তিভিত্তিক মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সোমবার (২ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকার গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মানসম্মত পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা বাস্তবায়ন হয় শিক্ষা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই। এ কারণে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত না করে পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অনেকাংশেই দুরূহ। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের দায়িত্বটুকু শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চাওয়াটুকুরও মূল্যায়ন করা দরকার।

দু'দিন সাপ্তাহিক ছুটি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরের বছর সাপ্তাহিক ছুটি দু'দিন ঘোষণা করেছিল। সে সময় সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ যারা করেছিল, সময়ের পরিক্রমায় তারাই ২০০৫ সালে সাপ্তাহিক ছুটি একদিনের পরিবর্তে শুক্র ও শনি দু'দিন করায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৫ তারিখে প্রকাশিত গেজেট মোতাবেক সরকার সব সরকারি, আধা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জন্য দু'দিন সাপ্তাহিক ছুটিসহ অফিস সময়সূচি পুনর্নির্ধারণ করে। ১ সেপ্টেম্বর ২০০৫ থেকে কার্যকর এই গেজেটে শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারণ করা হয়। অবকাশ বিভাগ বাদে সব সরকারি, আধা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করে। কিন্তু অবকাশ বিভাগ হওয়ার কারণে সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো সপ্তাহে একদিন ছুটি ভোগ করে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে সরকারি স্কুল-কলেজগুলো কি সরকারি অফিসের আওতায় পড়ে না? এটিকে অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। অনেকেই স্বাভাবিক ধারণা পোষণ করেন যে, স্কুল-কলেজগুলোতে বছরের বেশিরভাগ সময় ছুটি থাকে। সুতরাং তাদের সপ্তাহে দু'দিন ছুটি অপ্রয়োজনীয়। আসলে কি তাই? বাস্তবতা বোঝা দরকার।

দেশের অন্যান্য অবকাশ বিভাগের মধ্যে বিচার বিভাগ একটি। সে হিসেবে বিচার বিভাগ আর শিক্ষা বিভাগ একই অনুপাতে ছুটি ভোগ করার কথা। বিচার বিভাগের ছুটির তালিকায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে ছুটির তালিকা অনুযায়ী তারা ১৮১ দিন ছুটি ভোগ করেছেন, ২০১৯ সালে ভোগ করছেন ১৮৪ দিন। সে তুলনায় শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটি ভোগ করেন ৭৯ দিন+৫২ (শুক্রবার) দিন=১৩১ দিন। আবার অবকাশ বিভাগ নয় এমন বিভাগগুলো ছুটি ভোগ করে ৫২+৫২ (শুক্র+শনি)+২২ নির্বাহী ছুটি=১২৬ দিন। 'ছুটি বিধি ১৯৫৯' অনুযায়ী অবকাশ বিভাগ বাদে অন্য বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তারা গড় বেতনে প্রতি ১১ দিনে একদিন অর্জিত ছুটি পান। সে তুলনায় মাত্র ৫ দিন বেশি ছুটি ভোগ করে অবকাশ বিভাগ বিধায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তারা অর্জিত ছুটি পান অর্ধগড় বেতনে প্রতি ১২ দিনে ১ দিন। ফলে অবসরকালে দারুণভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। আবার অবকাশ বিভাগ হিসেবে পরিচিত একই মন্ত্রণালয়ের একই অধিদপ্তরের অধীন শিক্ষা বিভাগের অফিসে কর্মরত ও মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যেও ছুটির রকমফের আছে। সরকারি কলেজ, টিটি কলেজ, মাউশি, নায়েম, ব্যানবেইজ, এনসিটিবি, শিক্ষা বোর্ড, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, জেলা শিক্ষা অফিস, প্রাথমিক জেলা শিক্ষা অফিস, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়- সবই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। মজার ব্যাপার হলো, সরকারি স্কুল-কলেজে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তারা সপ্তাহে ছুটি পান ১ দিন আর কলেজ ব্যতীত অন্য সব অফিসে কর্মরতরা সাপ্তাহিক ছুটি পান দু'দিন।

এ বিভাগে কর্মরত থাকায় সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে কলেজগুলোতে অবকাশ ছুটিযাপনের পথ আরও সংকীর্ণ। বেশিরভাগ শুক্রবারই চলে যায় নিয়মিত দায়িত্বের বাইরে দেশের সেবায় বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালনে। অবকাশকালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, প্রায় সারা বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, ফরম পূরণ ও পরীক্ষা থাকার কারণে অবকাশযাপনের নূ্যনতম সুযোগও নেই। আবার এ ক্ষতির বিনিময়ে কোনো অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তারা। ফলে ভ্যাকেশন শব্দটা এখন তাদের কাছে অনেকটা গলার কাঁটা। সরকারি কলেজগুলোর কথাই ধরা যাক। কলেজে অফুরন্ত ছুটি ভোগের ধারণা যারা পোষণ করেন, তাদের বোঝার জন্য কলেজে কর্মরত কর্মকর্তাদের কাজের ব্যাপ্তি আলোচনা করা দরকার। ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে অন্য ক্যাডারের সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বৈষম্য আছেই, কাজের ব্যাপ্তিতেও সুস্পষ্ট ব্যবধান আছে। অন্য ক্যাডার বা বিভাগের কর্মকর্তারা সাধারণত সকাল ৯টা-৫টা দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা ক্যাডারের কলেজে কর্মরত কর্মকর্তাদের সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ৯টায় এসে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা ক্লাস নিতে হয়। মানসম্মত পাঠদানের জন্য এই ক্লাসগুলোর প্রস্তুতির জন্য আগের রাতে কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা স্টাডি করা লাগে। পরীক্ষার দিনগুলোতে চলে একটানা বিকেল ৪টা, ৫টা বা ৬টা পর্যন্ত। এর বাইরে যারা কমিটিতে কাজ করেন, তারা রাত অবধি ব্যস্ত থাকেন এই কাজে। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ও পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজটি করতে হয় অফিস টাইমের বাইরে, অফিসে বসে অথবা বাসায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ পরীক্ষা অবকাশের মধ্যেই চলছে। এ কারণে অবকাশের ছুটি ভোগের সৌভাগ্য সরকারি কলেজে কর্মরত কর্মকর্তাদের হয় না। ফলে নামমাত্র অবকাশ বিভাগ হলেও অবকাশ বিভাগের সুবিধাটুকুও এখানে সোনার হরিণ।

যাদের ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ, সেই শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধাও বিবেচনায় আনা দরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মঘণ্টা যেখানে ৯-২টা এবং সপ্তাহে ছুটি দু'দিন। সেখানে স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় ৯টা থেকে ৪টা সপ্তাহে ৬ দিন। একটানা ৬ দিন স্কুল-কলেজের গণ্ডিতে থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে টেকসই শিক্ষা গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে মানসম্মত শিক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি দূর করতেও সাপ্তাহিক ছুটি বৃদ্ধি জরুরি। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, শিক্ষকরাও অবসাদগ্রস্ত হন ও শ্রেণি পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণের যথেষ্ট সময় পান না। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে এটি চরম বাধা।

যেহেতু বাস্তব কারণেই অবকাশ বিভাগ হিসেবে শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকার যথাযথ সুরক্ষা সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রয়োজনেই শিক্ষা বিভাগকে অবকাশ বিভাগ থেকে মুক্ত করে অন্যান্য বিভাগের মতো সাপ্তাহিক ছুটি দু'দিন নির্ধারণ করাই যৌক্তিক হবে। তাতে একদিকে যেমন শিক্ষক-কর্মকর্তারা অবকাশ ছুটি ভোগ করতে না পারার কষ্ট থেকে মুক্ত হবেন, অর্জিত ছুটির ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, সেটা বন্ধ হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মস্পৃহা বাড়বে। অন্য বিভাগের তুলনায় তাদের সাপ্তাহিক ছুটি কম ভেবে মানসিক অস্থিরতায় ভুগবেন না, সরকারের অন্য বিভাগগুলোর সঙ্গে মানসিক বৈরিতা কমবে ও সম্পর্কোন্নয়ন ঘটবে।

 

লেখক: শওকত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, হাজী এবি কলেজ

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036320686340332