এটি কোনো গবেষণা বা জরিপপত্র নয়; একজন সাধারণ অভিভাবকের কিছু পর্যবেক্ষণ। তাও একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বোর্ডের কয়েকটি পাঠ্যবইকে কেন্দ্র করে।
প্রথমেই উল্লেখ করব বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইটির কথা। ১০৮ পৃষ্ঠার শৃঙ্খলাবোধ; রচনা শুরু করা হয়েছে মহান দার্শনিক রুশোর বক্তব্য দিয়ে-Man is born free, but everywhere he is in chain. শিকল আর শৃঙ্খলা এক নয়। রুশো মানুষের মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন। এই উদ্ধৃতিটি এখানে যথোপযুক্ত হয়নি বলে মনে হয়। দর্শনীয় স্থান রচনায় (পৃষ্ঠা ৯৫) বলা হয়েছে, ১৯৫৯ সালে নাটোর পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত হয়। এটি সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশের সব মহকুমা জেলায় পরিণত হয় জেনারেল এরশাদের শাসনামলে। ১৯৮৩ থেকে '৮৬ সালের ভেতর কাজটি শেষ করা হয়। এ ছাড়া সার্বিকভাবে রচনা লেখাতেও কিছু পরিবর্তনের চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে নদনদী রচনায় তিস্তা নদকে ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা উভয়ের উপনদী বলা হয়েছে। এটি বিভ্রান্তিকর। গতানুগতিকভাবে নদনদীর উপকারিতা ও অপকারিতা লেখা বেমানান দেখায়। নদনদী প্রাকৃতিক সম্পদ। এর থেকে সুবিধা আদায় আমাদের দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে। পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নির্ভর করে সরকারের কর্মতৎপরতা ও দূরদর্শিতার ওপর।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়ের তৃতীয় পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালে ঢাকায় গণপরিষদের অধিবেশন বসলে ছাত্ররা গণপরিষদ ঘেরাও করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দিনটি ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। আসলে সেখানে চলছিল প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। দুঃখজনক হলো, এই ভুলটি বাংলা পিডিয়াতেও করা হয়েছে, যেটা কিনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের একটি জ্ঞানকোষ।
এবার সিলেবাস নিয়ে একটু কথা বলতে হয়। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রদের কিছু প্রাথমিক ধারণা দেওয়া প্রয়োজন, যা হবে সংক্ষিপ্ত ও বোধগম্য। কৃষি কথা বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে কৃষি এবং আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ সংক্ষেপে জ্ঞান দান করা যেত। তা না করে আদিকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কৃষির বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায় কৃষি প্রযুক্তিতে সেচ পদ্ধতির এত বিশদ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যেন ছাত্রটি অষ্টম শ্রেণিতে উঠে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার সেচ বিভাগে চাকরি করতে যাবে।
এবার আলোচনা করতে হচ্ছে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এবং সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে। প্রতিটি পাঠের পর পাঠ্যবইতে নমুনা বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এবং সৃজনশীল প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। বহু নির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন হবে না যদি মূল পাঠটি ভালোভাবে পড়ে এবং এক ছাত্রকে অবশ্যই তা করতে হবে। আর সৃজনশীল প্রশ্নে, উদ্দেশ্য একটি ছাত্রের সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো। সৃজনশীল প্রশ্ন যদি যা পড়া হয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে, তাহলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ঘটনা ঘটছে অন্যভাবে। এই সৃজনশীল প্রশ্নের প্রশ্নকে পুঁজি করে প্রবলভাবে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে কোচিং সেন্টার এবং সহায়ক বইয়ের ব্যবসা। আজ পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে ওপরের দিকে প্রত্যেক ছাত্রকে স্কুল এবং কোচিং ক্লাসে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কাটাতে হয়। কী করে এই ব্যাধি ছড়ানো হয়েছে তার একটা সুনির্দিষ্ট উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো। সপ্তম শ্রেণির সপ্তবর্ণা বইতে মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীবের একটি লেখা রয়েছে; শিরোনাম- 'পিতৃপুরুষের গল্প'। সেখানে বলা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা। নিবন্ধের চরিত্রের বাড়ি জামালপুর জেলায়। যা হোক সেখানে সৃজনশীল প্রশ্নে যে প্রশ্ন করা হয়েছে, তা কঠিন কিছু নয়। অনুরূপ প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া কঠিন হবে না। কিন্তু সহায়ক বইতে দেখা গেল, একজন উদ্দীপককে উত্থাপন করতে গিয়ে বলছে যে, সে বাড়ির খবর জানে না। জামালপুর কোন সেক্টরে তা জানে না। এই প্রশ্নের অবতারণা করা উদ্দেশ্যমূলক। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রকে মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন অঞ্চলে কোন সেক্টরে তা জানার প্রয়োজন নেই বা সেই বয়সও তার হয়নি। এভাবে প্রতিটি পাঠের বিপরীতে অপ্রাসঙ্গিক উদ্দীপকের প্রশ্ন আনা হয়। আজ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রতিটি পাঠের বিপরীতে ১৫-১৬টি এমন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে হয়, যার জন্য তাকে কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের শরণাপন্ন হতে হয়।
আগে নবম-দশম শ্রেণিতে এসে ছাত্ররা টেস্ট পেপার সমাধান করত। এখন ছাত্ররা চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি থেকে মিনি টেস্ট পেপার সমাধান করে। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলা যায়- ৯৯ শতাংশ ছাত্রের এই অবস্থা। ভারি সিলেবাস ও সৃজনশীল পদ্ধতির নামে ছাত্রদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তোতা কাহিনী গল্পের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ছাত্রদের এই অমানবিক শিক্ষার পরিবেশ থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। সৃজনশীলতার গ্যাঁড়াকলে এদের মৌলিক সৃজনশীলতার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত অবিলম্বে নতুন করে বিভিন্ন কমিটি গঠন করে প্রথমত ভুলগুলো সংশোধন এবং গতানুগতিক লেখার অবসান ঘটিয়ে নতুন গতি ও প্রাণ সঞ্চার করা। আর সৃজনশীলতার ক্যান্সার ব্যাধি থেকে ছাত্রদের রক্ষা করা। তারা যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছিলেন, সেটি জন্য রক্ষা পায়। দুরভিসন্ধিমূলক যারা এর অপব্যবহার করে কোচিং বাণিজ্য ও গাইড বই ব্যবসা চাঙ্গা করতে চলেছে, তাদেরক নির্মূল করতে হবে।
বিষয়টা জটিল নয়। এখন তো সাধারণ শিক্ষার জন্য বোধ করি ৯-১০টা বোর্ড। অতএব, এলাকা তত বিশাল নয়। এই ব্যাধি দূর করতে প্রত্যেক বোর্ডে একটি সেল থাকবে। সেই সেল বার্ষিক পরীক্ষার পর বিভিন্ন স্কুলের প্রশ্নপত্রের র্যানডম চেক করবে এবং যারা অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। তাহলে অবশ্য এ ব্যাধি দূর হবে।
কলাম লেখক
সূত্র: সমকাল