২৬ জুন ২০১৯ কালের কণ্ঠ’র মুক্তধারায় সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমানের ‘সৎ কর্মচারীদের খোঁজ পেলে অসেদরও পাওয়া যাবে’ লেখা পড়ে আমার চেতনার প্রতিক্রিয়ায় আজকের এই নিবেদন।
বিদ্যাসাগরের দাদা রামজয় তর্কভূষণ চারপাশের তথাকথিত অভিজাতদের এড়িয়ে চলার জন্য বাঁশবাগানের বিষ্ঠাময় পথে যাতায়াত করতেন। আমার মা ছেলেবেলায় আমাদের বলতেন, ‘গু দিয়ে যাবি, দরবার দিয়ে যাবি না।’ মায়ের আদেশ শিরোধার্য করার জন্য নয়, বরং আমার নিয়তি আমাকে দরবার তথা সমাজকথিত এলিটদের সঙ্গে মেশার সুযোগ দেয়নি। সব হারাদের মাঝেই আমার কালাতিপাত। তবে লেখাপড়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং জীবিকার প্রয়োজনে সেকাল ও একালের স্কুল-মাদরাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কিঞ্চিৎ সুযোগ আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার সুবাদে কিছু সৎ শিক্ষকের পরিচয় আমার অতি দুর্বল স্মৃতি ধরে রেখেছে। জনান্তিকে বলে রাখি, আমার বাবাও শিক্ষকতা করতেন। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্র জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন গোলাম কবির।
পণ্ডিত শিক্ষকরা ভাবতেন, শিক্ষকতা চাকরি নয়। চাকরি মানেই অধীনস্থ হওয়া। তাঁরা ন্যায়-নীতি ও বিবেকের দাসত্ব করতেন। ব্যক্তির কিংবা সরকারের নয়। ফলে তাঁরা মাথা উঁচু করে চলতেন। শিক্ষাদানে নিষ্ঠার অভাব তাঁদের ছিল না। যেদিন থেকে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু হলো, শিক্ষকতায় শ্রেণিবিন্যাস শুরু হলো তখন থেকেই কিছু শিক্ষক পরস্পরকে অতিক্রম করার জন্য প্রতিযোগিতায় নামলেন। সভ্যতা সৎ-অসৎ অভিধা সঙ্গে নিয়েই অগ্রসরমাণ। শিক্ষকরা সমাজের অনুষঙ্গী। তাঁরাও সৎ অথবা অসৎ হতে পারেন—এটা অলৌকিক নয়। তবে অসততার মাত্রা অতিক্রম করলে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ্য থাকতে পারেন না।
শিক্ষক বলতে আমরা বুঝি, কোনো বিষয়ে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি, সেই বিষয়ে অপরকে জ্ঞানদানে প্রবৃত্ত হওয়া ব্যক্তিকে। তাঁর পৃথক কোনো তকমা নেই। এখন সব বিষয়ে বিশেষায়িত সনদ নিয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে নামছেন শিক্ষক নামের পরিচিতি নিয়ে। প্রসঙ্গত একটি অপ্রিয় সত্য বলে রাখি, বিষয়ভিত্তিক সনদ নিয়ে আসা শিক্ষকদের কতজন নিজ বিষয়ে সম্যক দখল রাখেন। যদি দখল না থাকে, তবে শিক্ষকতায় প্রবেশ করাই তাঁর জন্য অপরাধ বা অসততা। আমরা কমবেশি সবাই সেই অপরাধে যুক্ত। এই সত্য স্বীকার করে নিয়েও নিরন্তর সৎ থাকার চেষ্টা করে যাওয়াই শিক্ষকের কাজ।
আতিকুর রহমান প্রজাতন্ত্রের সৎ কর্মচারীদের খোঁজার কথা বলেছেন। সে জগৎ আমার প্রায় অজ্ঞাত। আমি বাধ্য হয়ে শিক্ষকতায় ছিলাম। তাই এ সম্প্রদায়ের অসততা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে। দেখেছি, অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার জন্য প্ররোচিত করেন। শেখানো অপেক্ষা প্রশ্নপত্র বলে দেওয়া, নম্বর বেশি দেওয়া ইত্যাদির জন্য শিক্ষার্থীরা প্রলুব্ধ হয়। এঁদের সংখ্যা সীমিত হলেও এঁরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। সরকার প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং ব্যবসা ঠেকানোর নানা কৌশল অবলম্বন করছে। বাস্তবে তা কতখানি প্রতিফলিত! আসলে মেধাবী এবং জাত শিক্ষকের নিয়োগ ছাড়া কোনো রন্ধ্রই বন্ধ করা যাবে না। এসব সত্য জানা সত্ত্বেও দেশের আনাচকানাচে শিক্ষক নামের অনেক প্রকৃত শিক্ষাবর্জিত ব্যক্তিকে জনগণের ট্যাক্সের টাকার অংশীদার করা হচ্ছে। অর্থাৎ শিক্ষক পদবাচ্য হওয়ার যোগ্যতার অভাব জেনেও তাঁদের বরমাল্য দেওয়া হচ্ছে। নিজ বিষয়ে সঠিক মূল্যায়নের দুর্বল ব্যক্তি কখনো সৎ হতে পারেন না। এ সত্য সর্বজনবিদিত।
স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক কিছুটা পরিশ্রম করে অসততার কাজে লিপ্ত। এটা আমাদের সমাজ জায়েজ করে দিয়েছে। তবে যাঁরা কোনো শ্রম না দিয়ে, ভ্রষ্টবুদ্ধির কৌশল খাটিয়ে অসৎ কাজ করছেন, তা আমরা বেশি খতিয়ে দেখি না।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কিছু শিক্ষক ঠিকমতো ক্লাস নেন না। সিলেবাস পুরোটা শেষ করেন না। পরীক্ষার আগে গোঁজামিল দেন অথবা নির্দিষ্ট প্রশ্ন বলে দেন। আর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন পাস করিয়ে দেওয়ার অলিখিত চুক্তি থাকে। এটা কোন ধরনের সততা—তার সংজ্ঞা আমার জানা নেই।
দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এক শ্রেণির শিক্ষক নামের জন্তু কন্যা শিক্ষার্থীদের লালসার পাত্রে পরিণত করছেন। জানি না, এটা কোন ধরনের নৈতিকতা বা সততা। পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা তুলনা করব না। আমাদের সুদীর্ঘকালের শিক্ষা—শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগুরুর মানসসন্তান। এই সন্তানের ওপর চড়াও হওয়ার মানসিকতা মানবিকতার কোনো মানদণ্ডে বিচারের তুল্য নয়। এটাও আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে।
অনেকেই নিজ বিষয়ে পারদর্শী। বাজারে তার মূল্য বেশি। অথচ সততা, নিষ্ঠার ক্ষেত্রে অসচেতন। নির্ধারিত সময়ের পরে শ্রেণিকক্ষে যাওয়া, মন্থরগতিতে ছাত্র হাজিরা গ্রহণ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিগত গল্পগুজবে ৪৫ মিনিট সময়ের বেশির ভাগ কাটিয়ে দেন। তারপর পঠিতব্য বিষয়ের ভূমিকা করতেই সময় শেষ হয়ে যায়। এমন আপাত সততা শিক্ষার ক্ষেত্রে নীরব ঘাতক।
আমরা আলোচনার সূচনায় বিদ্যাসাগরের পিতামহের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছি। তার মোজেজা হলো তাঁর পৌত্র ঈশ্বরচন্দ্র সমকালীন স্রোতে গা না ভাসিয়ে ‘অপরাজেয় পৌরুষে’ শিক্ষাক্ষেত্রে ও জীবনে যে সততার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা অনুধাবন করতে পারলে শিক্ষা ও সমাজ কিছুটা মালিন্যমুক্ত হতো। শুধু নৈতিক কেতাবি শিক্ষা নয়, ব্যক্তির জীবনের কর্মধারা অধস্তনদের প্রাণিত করে, অর্থাৎ দেখে শেখে। আমরা এই সততার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে সমাজের কোনো স্তরে ক্যান্সারের মতো অসততা বাসা বাঁধবে না।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ