একটা সময় ছিল যখন ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রীলঙ্কা, নেপালের ছাত্র-ছাত্রীরাও ডিগ্রি নিত। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরাও এখানে পড়তে আসত। সেই পশ্চিমবঙ্গেই এখন নতুন শিক্ষা ব্যবসা আমদানি করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর কলেজে ভর্তি হতে গেলে হাজার বিশেক টাকা খরচ করতে হয়। আর পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে চাইলে সেই অঙ্ক বেড়ে যেতে পারে আরো কয়েক গুণ। শাসকদলের ছাত্র ভর্তির সিন্ডিকেটের চাপে পড়ে এখন নাভিশ্বাস উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের।
সবটাই নির্জলা মিথ্যা। শব্দটা হয়তো শাস্ত্রসম্মত নয়। কিন্তু কলেজে ভর্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রী থেকে শুরু করে গোটা শাসকদল সংবাদপত্র ও মিডিয়ার সামনে বাইটে নিত্যদিন যে চড়া গলায় হম্বিতম্বি করে চলেছেন, তাকে এ ছাড়া আর কিছু বললে বিষয়টি ততটা বোধগম্য না-ও হতে পারে। ১০০ শতাংশ লোক দেখানো বুলি আওড়ে চলেছে তারা তোলাবাজদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে দল থেকে বহিষ্কার ও আরো অনেক কঠোর শাস্তির যেসব হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তা নেহাতই ফাঁকা আওয়াজ। আর নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-সন্ত্রাসীদের এসব হুমকি যে নেহাতই বাগাড়ম্বর, তা খুব ভালো করেই জানেন কলেজে কলেজে দাপিয়ে বেড়ানো ‘দাদা-দিদিরা’। কারণ তাঁরা জানেন, এমনকি এখন কথাটা যখন-তখন দলের বিরুদ্ধে আঙুল উঁচিয়ে বলে থাকেন যে আমরা হলাম দলের ‘ভোট-ক্যাচার’। ভোটের সময় অপোনেন্টদের মেরেধরে, প্রয়োজনে মাথা ফাটিয়ে, এমনকি খুনও করে তৃণমূলের ভোটার বাক্স ভরাতে যাব আমরা কোন দুঃখে? যদি না সংবৎসর আমাদের কামাইয়ের সুযোগ না করে দেয় দল?
কলেজে ভর্তিতে অসহায় অভিভাবকদের কাছ থেকে ২০ হাজার, ৫০ হাজার, কোথাও বা লাখ টাকার লুঠমার সেই কামাইয়েরই একটা বড় অঙ্গ। এই নির্মম সত্যিটাই হলো বর্তমানে কলেজ ভর্তিসংক্রান্ত ভয়ংকর সমস্যার মূল কথা। যার ফলে প্রতিবছর যখন বারদুয়েক ভোট আসে, সেই ভোটে যখন জোরজবরদস্তি ও গুণ্ডামি করে ভোট দখলের প্রয়োজনটা নিতান্তই অপরিহার্য, তখন ততোধিক অনিবার্য কলেজ ভর্তিতে এই ঘুষের রাজত্ব।
কলেজে ভর্তিসংক্রান্ত এই সমস্যা নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ছাপোষা পরিবারগুলোতে যে ভয়ংকর এক বিভীষিকা এনে দিয়েছে, তাতে রাজ্যের শিক্ষামহল যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা, রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা যে ক্রমেই এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে যাচ্ছে, এসব ঘটনা থেকে তা পরিষ্কার। এ ব্যাপারে বিশেষত উদ্বিগ্ন রাজ্যের বামপন্থী মহল।
ভালো কলেজে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার স্বপ্ন বছরের পর বছর ধরে ধ্বংস হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। ২০১২ সাল থেকেই এই অধঃপতনের শুরু, আজ যা প্রায় আতঙ্কে পর্যবসিত হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আসা লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর সামনে কলেজে ভর্তি হওয়া এক দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপথ্যে শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া সিন্ডিকেট-রাজ। সারা বছর দেখা না পাওয়া এই নেতাকর্মীরা ঠিক নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার সময় সামনে চলে আসে। আর তার পরই চলতে থাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নাম করে দেদার টাকা তোলার খেলা। প্রতিবারই শাসকদলের শীর্ষ নেতারা এই তোলাবাজির নিন্দা করেন, এবারও করেছেন। কিন্তু তা আটকানোর কোনো উদ্যোগই কোনো পর্যায় দেখা যায় না। দুর্নীতি ঠেকাতে নামকাওয়াস্তে একটা অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভুক্তভোগীদের কাছে তা একটা প্রহসনেরই নামান্তর। শিক্ষাবিদরাও নিরুপায়। হা-হুতাশ করা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই তেমন করার নেই।
সিন্ডিকেটের তোলাবাজিতে জেরবার ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ, অনলাইনে মেধাতালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও টাকা না দিয়ে ভর্তির কোনো সুযোগই নেই। ফলে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে দিল্লি, ওড়িশার মতো রাজ্যে ভর্তির চেষ্টা শুরু করে। এই আক্ষেপ উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠনের (ওয়েবকুটা) সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজের কথাতেও।
তিনি স্পষ্ট অভিযোগ করে বলেছেন, ‘যে সিন্ডিকেট এখন ছাত্র ভর্তির নাম করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তুলে চলেছে, তারা রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা শাসকদলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে দিন দিন সিন্ডিকেটের বেপরোয়া মনোভাব বেড়েই চলেছে।’ তাঁর অভিযোগ, অনলাইনে কাউন্সেলিং এবং ভর্তি প্রক্রিয়া রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটিকে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক করার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। তা তৈরি করার কোনো সদিচ্ছাও নেই বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর।
প্রবীণ এই শিক্ষাবিদদের অভিযোগ, কলেজের প্রিন্সিপালসহ যে প্রশাসন ভর্তির বিষয়টি পরিচালনা করে থাকেন, তাঁদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভর্তি চক্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর ফলেই শিক্ষাব্যবস্থায় এই নৈরাজ্যের শিকড় এতটা গেড়ে বসতে পেরেছে। তিনি বলেন, শাসকদলের প্রত্যক্ষ মদদেই কলেজের প্রধান তাঁর অধস্তন কর্মী-অফিসারদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন। তাঁর মতে, গত ছয়-সাত বছর ধরে শুধু কলকাতা নয়, জেলা স্তরেও কলেজকে ঘিরে যে চক্র গড়ে উঠেছে, তা শুধু ভর্তি নয়, শাসকদলের হয়ে মানুষের দৈনন্দিন সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার কেন্দ্র। কলেজে ভর্তির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই তা প্রতিবছর সামনে চলে আসছে। বর্তমান শাসকদলের সহজ রাস্তা হলো, কোনোভাবে মেধাকে সরিয়ে দিতে পারলেই টাকা রোজগারের রাস্তা সুগম হবে।
শ্রুতিনাথ বাবু বলেছেন, অনলাইন ব্যবস্থার পূর্বশর্তই হলো, মেধাই হবে সংরক্ষিত আসনসহ ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকা তৈরির একমাত্র বিচার্য বিষয়। এর পাশাপাশি কলেজগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শাসকদলের নিজস্ব নিয়োগ পদ্ধতি রয়েছে। এই বাহিনীটা কাজে লাগে ভোটের সময়। সে কারণে সিন্ডিকেটের চাঁইদের ঘাঁটাতে চান না শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী কেউই। শিক্ষামন্ত্রীর হুংকার, মুখ্যমন্ত্রীর কলেজ পরিদর্শনের মতো লোক-দেখানো নাটক প্রতিবছরই হয়। কিন্তু ভর্তি সিন্ডিকেটের মাতব্বরদের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কারো নেই। সে কারণেই উত্তর কলকাতায় একাধিক কলেজে পুলিশের সামনেই অভিভাবকদের সঙ্গে টাকা-পয়সার ডিল চলতে পারে।
উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর অনলাইনে মেধা তালিকা দেখার সুযোগ রয়েছে। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বরভিত্তিক তালিকা দেওয়া হয়, অনেকের আবার সেখানে নাম থাকেও না। নাম থাকুক বা না থাকুক, সিন্ডিকেটের দাদাদের দাবিমতো টাকা গুনেগেঁথে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। পছন্দের কলেজে পছন্দের বিষয় নিয়ে ভর্তি নিশ্চিত। চলতি বছরে ভর্তি সংকট শুরু হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, শহরে অনলাইনের সুবিধা থাকলেও, গ্রামাঞ্চলে এখনো অনলাইন ব্যবস্থায় পুরো বিষয়টি করা সম্ভব নয়। গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের কথাও তো ভাবতে হবে। শিক্ষামন্ত্রীর এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে শ্রুতিনাথ বাবু বলেছেন, গ্রামবাংলার ছেলে-মেয়েরা যাদবপুর বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েবসাইট ঘেঁটে আবেদন করতে পারছে। তাহলে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় তাদের অসুবিধা হবে কেন?
টাকা নিয়ে কলেজে ভর্তির সিন্ডিকেট চালানোর অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে, সেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভানেত্রী জয়া দত্ত অবশ্য বলেছেন, তাঁর সংগঠন অনলাইন ভর্তি প্রক্রিয়ায়ই বিশ্বাসী। তাঁর মতে, যে অভিযোগগুলো উঠছে, সেগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তিই নেই। কারণ গোটা রাজ্যেই নাকি ছাত্র-ছাত্রীরা অনলাইনে তাদের নাম দেখে অনলাইনে টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হতে পারছে। যাদের নাম তালিকায় নেই, একমাত্র তাদের অভিভাবকরাই কলেজে এলে ইউনিয়নকে ধরছে। তারাই ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করানোর জন্য টাকার প্রলোভন দেখাচ্ছে। জয়া দত্তের মতে, এটা একটা সামাজিক ব্যাধি।
এদিকে ভুক্তভোগী ছাত্র-ছাত্রীরা বলছে, অনলাইনে নাম দেখার পর কাউন্সেলিংয়ের জন্য কলেজে আসতে হয়। আসল খেলা শুরু হয় তখনই। কলেজের গেট জ্যাম করে রাখা টিএমসিপির দাদারা বলেন, কাউন্সেলিংয়ের অসুবিধা হবে। কিন্তু বাইরে টাকা দিয়ে রফা করে নিলে আর কোনো অসুবিধা হবে না। মেধাতালিকায় নাম না থাকলেও আরামসে ভর্তি হওয়া যাবে।
টাকা নিয়ে ছাত্র ভর্তির ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাম ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি বলেন, ‘যা হচ্ছে, তা হওয়া উচিত নয়। যেভাবে টাকার খেলা চলছে এবং মাঝেমধ্যে তৃণমূলের পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে, তাতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃতপক্ষে কোনো লাভই হচ্ছে না। বিভিন্ন বিষয়ের অনার্সে বিভিন্ন ধরনের কোটা স্থির হয়েছে। একবার দেখলাম কোনো কলেজ থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাতে কী লাভ হলো বুঝতে পারছি না। কলেজে ভর্তির তোলাবাজি অব্যাহতই রয়েছে এবং সিন্ডিকেট-রাজও ভালোভাবেই চলছে। গণতন্ত্র ধ্বংস করতে থাকলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রপ্রেমী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আবেদন করব, তারা যেন এ ক্ষেত্রে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে। অনেক ঢক্কানিনাদ করে অনলাইন ভর্তির ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু তা থাকা সত্ত্বেও কেন এভাবে টাকার খেলা চলছে, তার জবাব দিতে হবে শিক্ষা দপ্তর ও সরকারকে। শিক্ষার অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করতে হলে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
এক সংবাদ সম্মেলন করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি তোপ দেগেছেন বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীকে বারবার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। কলেজে কলেজে ভর্তি নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে আমাদের রাজ্যের মানসম্মান নষ্ট হচ্ছে। চূড়ান্ত দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলায় ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। ছাত্র সংসদ দখলে রাখা কিছু ছাত্র এবং অছাত্রের দুর্নীতিতে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে আসন কেনাবেচা চলছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গরিব মেধাবী ছাত্ররা।
তিনি বলেন, কলেজের গেটে দুষ্কৃতদের দাপট বা পুলিশের পাহারা কোনোটাই শুভ লক্ষণ নয়। বাম ফ্রন্ট সরকারের আমলে তো এখনকার শাসকদলের বিধায়করাও পাস করেছেন। তাঁদের কাউকে ভর্তির জন্য এভাবে টাকা দিতে হয়েছে? এখন ভর্তির জন্য ৫০-৬০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের মেধা অনুসারে ভর্তি হবে। সেখানে কারো বদান্যতা, আনুগত্যের প্রশ্ন আসছে কেন?
লেখক : কলকাতার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক