আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর এক বছরে অনেকটাই বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছে দেশের শিক্ষা খাত। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। সহযোগী হিসেবে পান উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে। একাধিক শুভ উদ্যোগ নিয়ে তারা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাব্বির নেওয়াজ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, তবে বছরজুড়েই দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত দু'জন উপাচার্যকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধেই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। যদিও পরে তা স্তিমিত হয়। ১১ মার্চের এ নির্বাচনে ছাত্রলীগ একচেটিয়া জয় পেলেও ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর।
এর বাইরে বছরজুড়ে নানা অস্থিরতার কারণে বার বার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের ঘুষ কেলেঙ্কারির অডিও ফাঁস নিয়ে অস্থির ছিল পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের প্রথম বছরে শিক্ষা খাতে অর্জনও নেহায়েত কম নয়। দুই হাজার ৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বছরে এমপিওভুক্ত করা হয়। এতে প্রায় ১০ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী সরাসরি সরকারি বেতনের আওতাভুক্ত হয়েছেন। দেশে নতুন চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম এ বছরই শুরু হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে না হলেও দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন ভর্তি পদ্ধতি অনুসরণ শুরু হয়েছে। এ রকম আরও কয়েকটি সাফল্য রয়েছে শিক্ষা খাতে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা : বছর জুড়েই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল অস্থিরতা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এস এম ইমামুল হক শিক্ষার্থীদের 'রাজাকারের বাচ্চা' বলে গালি দিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে প্রথমে শিক্ষার্থীরা, পরে শিক্ষকরাও আন্দোলনে নামেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে উপাচার্য পদ ছাড়তে বাধ্য হন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনও।
গত বছর শিক্ষা খাতের আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড। ৬ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বুয়েট। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় দ্রুতই ধরা পড়ে দোষীরা। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এ প্রতিষ্ঠানে। আন্দোলন চলার সময় দীর্ঘদিন অচল ছিল বুয়েট।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় বছর জুড়েই ছিল অস্থির। বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও গাছ কাটা নিয়ে গত জুলাই মাসে সেখানে আন্দোলন শুরু হয়। অভিযোগ ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের কমিশন বাণিজ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যুক্ত। এমন প্রেক্ষাপটে তাদের দু'জনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সংগঠনের পদ থেকে সরে যান। বছরের শেষ দিকে নভেম্বরে এ আন্দোলনে যুক্ত হয় ভিসির পদত্যাগের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। তবে পদত্যাগ করেননি ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম।
এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল অস্থির।
বছরজুড়ে শিক্ষা খাতে অর্জন : টানা ৯ বছর পর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর দুই হাজার ৭৩০টি বেসরকারি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বন্ধ ছিল এমপিওভুক্তি। এ জন্য শিক্ষকরা দীর্ঘদিন আন্দোলনও করেছেন। অবশ্য এমপিওভুক্তির ঘোষণার পর এর ভুলত্রুটি নিয়ে শুরু হয় নতুন বিতর্ক। কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, শিক্ষার্থী কম, ভাড়া বাড়িতে শিক্ষাদান করা হয়, ত্রুটিপূর্ণভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে- এমন বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নামে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তি নিয়েও দেখা দেয় বিতর্ক। এমপিওভুক্তিকে বিতর্কমুক্ত করতে এখন চলছে তথ্যের যাচাই-বাছাই।
উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির দাবি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি অনুষদভুক্ত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে সক্ষম হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
চলতি বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্যতম বড় অর্জন ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বিশ্বস্বীকৃতি আদায়। ইউনেস্কো গত ২৫ নভেম্বর মুজিববর্ষকে বিশ্বস্বীকৃতি দেয়। ফলে এই বিশ্বনেতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী ১৯৫টি দেশে উদযাপিত হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের তত্ত্বাবধানে মুজিববর্ষের বিশ্বস্বীকৃতি আদায়ের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয়।
এর বাইরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী ও পরিমার্জনের কাজ শুরু, পাবলিক ও বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪০টি স্কুলে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মাধ্যমিকের সব ক্লাসে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ১৩ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার নতুন ভবনের কাজ শুরু করা, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে ২৪৯৪ জন নতুন জনবল অর্গানোগ্রামে যুক্ত করা, শিক্ষার মান উন্নয়নে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস, হবিগঞ্জ ও চাঁদপুরে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন, মাদ্রাসা বোর্ড আইন ২০১৯ পাস, পাবলিক পরীক্ষার জিপিএ গ্রেডিং সিস্টেম জিপিএ ৫ এর পরিবর্তে জিপিএ ৪ চালুর উদ্যোগ নেওয়া, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে 'বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কর্নার' চালু, শতবর্ষী ১৩টি কলেজকে 'সেন্টার অব এক্সিল্যান্স' হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে সিগারেটের দোকান না রাখার নির্দেশনা এবং নীতিশিক্ষার অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে সততা স্টোর চালু করা হয়েছে।
এক বছরের এসব অর্জন সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বিদায়ী সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, বিদায়ী বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরও বহু অর্জন রয়েছে। নতুন নতুন বহু উদ্যোগ আছে। এগুলোর ফল পেতে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা খাতের কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের ফলই রাতারাতি পাওয়া যায় না। এ জন্য অপেক্ষা করতে হয়।