শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি এবং কালের আবর্তে ছাত্র রাজনীতি - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি এবং কালের আবর্তে ছাত্র রাজনীতি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক রাজনীতি হওয়া সত্ত্বেও আজকের ছাত্র রাজনীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও অনেক বিস্তৃত। এই বিস্তৃতি ছাত্র রাজনীতিকে মহিমান্বিত করে না করে কলঙ্কিত। ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব ধরে রাখতে এবং ভবিষ্যতে মূল দলে নেতৃত্ব পেতে ছাত্রনেতাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। অর্থ আসে সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজিতে। ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব ছাড়া সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি সম্ভব নয়। তাই ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব ধরে রাখতেই সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে ছাত্রদের ওপর নির্যাতন অনেক সময় হত্যাও করতে হয়। এই ছাত্র রাজনীতিতে বন্ধুত্ব বা সহমর্মিতা বলে কিছু নেই। নেই কোন নীতি আদর্শ। অন্যকে মেরে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হওয়াই লক্ষ্য। শুক্রবার (৬ মার্চ) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়,  ’৭৫-এর পর নীতিহীন রাজনীতির ফসল আজকের ছাত্র রাজনীতি। ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ এই নীতিহীন রাজনীতি মূল রাজনীতির পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিকেও নীতিহীন করে তোলে। তারও পূর্বে জাসদ এদেশের ছাত্র রাজনীতিকে প্রথম ভুল পথে চালিত করে। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই ছাত্রদের প্রথম বিভ্রান্ত করে। এক সময় জাসদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অথচ মূল দল জাসদ কখনোই জনপ্রিয় ছিল না। জাসদের রাজনীতি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। জাসদের রাজনীতি ছিল অনেকটা সন্ত্রাসী দলের ন্যায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতাকারীরা তখন জাসদকে সরকারবিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে। এদের সম্পৃক্ততায় জাসদ নিজেদের জনপ্রিয় মনে করত।

কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ কখনও ভুল করে না। তাদের মনে জাসদ কোন স্থান করে নিতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সর্বক্ষেত্রেই এদেশের ছাত্র রাজনীতির যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল স্বাধীনতার পর সেই ছাত্র রাজনীতি কি পথ হারিয়ে ফেলে? এক সময় সামরিক শাসকদের প্রদর্শিত পথেও তারা পথ চলতে শুরু করে। আমাদের মেধাবী ছাত্রদের নৌ-বিহারে নিয়ে তাদের হাতে অর্থ আর অস্ত্র তোলে দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই শুরু হয় অর্থ আর অস্ত্রের পিছনে ছোটা। ভাবতে কষ্ট হয় সামরিক শাসক দ্বারা গঠিত একটি ছাত্র সংগঠন তখন ছাত্রদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হয়ে ওঠে। যে রাজনীতির সৃষ্টিই ৭ নবেম্বরের মিথ্যা বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে এবং মুশতাকের মিথ্যা নীতিকে ধারণ করেই যে রাজনীতি টিকে আছে সেই রাজনীতি ছাত্রদের কাছে এত জনপ্রিয় হয় কিভাবে? অর্থ আর ক্ষমতার মোহ হয়তো তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে। অথচ ছাত্ররাই সব সময় সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এসেছে। তাইতো নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনে আজও রাজপথ কেঁপে ওঠে। তা সত্ত্বেও আজ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা ভাবতে হয়। সামরিক শাসকদের হাতে ছাত্র রাজনীতি বিতর্কিত হলেও ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা আবার স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠনের মাধ্যমে আমাদের ছাত্ররা ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ’৯০-এর পর এমন কি ঘটল যাতে ছাত্ররাজনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটে? আমার মনে হয় ’৯০-এর পর এদেশের মূল রাজনীতিতেই আমূল পরিবর্তন ঘটে, যার প্রভাব ছাত্র রাজনীতিতেও পড়ে। 


এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসই সবচেয়ে গৌরবের। ৪৭ থেকে ৭১ অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল মূল ভূমিকায়। সে সময় কোন প্রলোভন ছাত্রদেরকে তাদের নৈতিকতা বা আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি। পারেনি ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করতে। আর সে সময়ের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস মানেই ছাত্রলীগের ইতিহাস। তখন ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ইতিহাস এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগের সে সময়ের ইতিহাসও এর কাছে মলিন মনে হবে। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, সর্বশেষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সর্বক্ষেত্রেই মূল ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া থেকে শুরু করে প্রথম স্বাধীন পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ সব আমাদের ছাত্র রাজনীতিরই কৃতিত্ব।

’৭৫-এর পর থেকেই আন্তর্জাতিক একটি মহল এদেশের সামরিক শাসকদের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে আমাদের তরুণদের ধ্বংসের পথে চালিত করতে চেয়েছিল। একটি দেশের তরুণদের ধ্বংস করা মানে সে দেশের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেয়া। আর এই ধ্বংসের হাত থেকে তরুণদের রক্ষা করতে বঙ্গবন্ধু কন্যা নিজ হাতে দায়িত্ব তুলে নেন। সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেই প্রথমে তিনি সকল অনিয়মকে নিয়মে আনতে চেষ্টা করেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ আর বাস্তবায়নে দেশে যেমন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে তেমনি দেশ অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে যেতে থাকে। এবার প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেন।

কিন্তু কাজটি কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। বিপথগামী তরুণদের শুধু সাজা দিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যাবে না, তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। এদেশের ছাত্রদের পরিকল্পিতভাবে বিপথগামী করা হয়েছিল। তাই পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা জানি আমাদের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য সঠিক পদক্ষেপই গ্রহণ করবেন। ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে প্রথমে বিপথে পরিচালিত হওয়ার যতগুলো পথ আছে সেগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে স্বল্প সময়ের জন্য শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ রাখা যেতে পারে। আবার বেশি সময় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখলে মৌলবাদী সংগঠন এর সুযোগ নিতে পারে। সমস্যা সমাধানে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা ছাত্রদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর সঠিক সমাধান দিতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাদেরকে দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করে। ছাত্রদের কল্যাণই তাদের কাম্য। তারাইতো আমাদের আলোকিত মানুষ, যারা প্রতি মুহূর্ত আমাদের তরুণদের আলোর পথ দেখান। ছাত্র রাজনীতির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের সঠিক পথটির সন্ধানও তারাই দিতে পারবেন। ছাত্র রাজনীতিকে রাজনীতি মুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ মূল রাজনীতি আর ছাত্র রাজনীতির মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন রেখা থাকতে হবে। দলীয় রাজনীতির স্বার্থে ছাত্র রাজনীতিকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশের প্রয়োজনে ছাত্ররা সব সময় রাজপথে নেমে এসেছে। দলীয় সমর্থনের প্রয়োজন হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আরও একটি কাজ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।


সৎ নেতৃত্বের গুণাবলী আর অসৎ নেতৃত্বের পরিণতি ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতে হবে। রাজনীতিতে সফলতার জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের সততা। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া আমাদের দুই নেত্রী, কোথায় ছিল তাদের অবস্থান আর বর্তমানে তাদের অবস্থান আমাদের ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। তাদের বোঝাতে হবে একই অবস্থানে থেকেও সবাই সমান অবস্থানে থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছাত্রদের সঠিক পথ দেখাতে পারে। চার জাতীয় নেতাসহ আমাদের সৎ, আদর্শ, ত্যাগী নেতাদের জীবন ও রাজনীতি তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তরুণদের বোঝাতে হবে নেতা হওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন হয় না। নেতা হওয়ার জন্য প্রয়োজন সততা আর মানুষের প্রতি ভালবাসা। তাদেরকে আরও বুঝাতে হবে নেতা হতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আর নেতৃত্বের পূর্ব শর্ত হলো সততা। সততার অভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নেতৃত্বও ধরে রাখা যায় না। তাই তরুণদের সামনে নেতৃত্বে¡র একটি আদর্শ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে দেশের নেতা সে দেশে অন্য কোন আদর্শের প্রয়োজন আছে? বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্ম জীবনী’ নেতা হওয়ার আদর্শ পাথেয় হতে পারে। এ দেশের এক একটি তরুণ ছাত্রনেতা ভবিষ্যতে একেকজন বঙ্গবন্ধু হয়ে গড়ে উঠবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাদের নেতৃত্বেই একদিন দেশ হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লেখক : মোঃ নাসিরুল আলম চৌধুরী, গবেষক

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004004955291748