শিক্ষাদাতারা যেন মাকাল ফল না হয় - Dainikshiksha

শিক্ষাদাতারা যেন মাকাল ফল না হয়

গোলাম কবির |

আমার কৈশোরে নগ্নপদচারী সাত্ত্বিক অভয় মাস্টার তখনকার শিক্ষার হাল সম্পর্কে একটি সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতেন এবং তাঁর চমৎকার ব্যাখ্যা শোনাতেন। ওই বয়সে ওসবের মহিমা মরমে পৌঁছত না আমাদের। আজ জীবনের অপরাহ্নবেলায় দাঁড়িয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝছি, কী মর্মভেদী সত্য তিনি উচ্চারণ করতেন! শ্লোকটি সম্পূর্ণ আমার মনে নেই। শুরু করতেন, ‘মধুজিহ্বাগ্রেতুষ্টি’ দিয়ে। পরের অংশের সমন্বয়ে যে অর্থ দাঁড়াত, তা হলো মধুসদৃশ বস্তু আস্বাদনে প্রথমে মিষ্টতার পুলক অনুভব করলেও পরিণামে সেখান থেকে গরল বেরিয়ে আসে। এখনকার শিক্ষা ও শিক্ষক দেখলে তিনি শ্লোক না আওড়িয়ে নির্বাক হয়ে যেতেন।

অভয় মাস্টার ছিলেন ‘ত্রিকালদর্শী’। ব্রিটিশ বাংলা, পাকিস্তান পর্ব এবং স্বাধীন বাংলা মিলে তিনি প্রায় শতবর্ষ জন্মভূমির মাটিতে কাটিয়েছেন। সর্বনাশা দেশভাগের পর তাঁর স্বজনরা অকৃতদার অভয় মাস্টারকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন শান্তির নিবাস খুঁজতে পশ্চিম বাংলায়। এখন তিনি অনন্ত ঘুমে জন্মভূমির মাটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকায়।

অভয় মাস্টার ব্রিটিশ বাংলায় বিদ্যা আহরণ করেছেন। তখনকার লেখাপড়া অনেকটা নিখাদ ছিল। ছিল না ডিভিশন, শ্রেণি, জিপিএ ইত্যাদি নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকের নির্ঘুম ঘর্মাক্ততা। মুখ্য উদ্দেশ্য জ্ঞানযোগ এবং জ্ঞানদান। কর্মসংস্থান-চিন্তা ছিল গৌণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনপ্রশাসন, তথাকথিত জনসেবা ইত্যাদি প্রয়োজনে শিক্ষিতজনের চাহিদা বাড়ল। জ্ঞান নয়, সস্তায় ডিগ্রি লাভের প্রবণতা বৃদ্ধি পেল। শিক্ষার্থীরা আকর্ষণীয় ফল লাভের জন্য পরীক্ষায় নানা কিসিমের অসদুপায় আবিষ্কার শুরু করল। দুঃখের বিষয়, এর নেতৃত্বে থাকলেন কিন্তু তথাকথিত শিক্ষক নামধারী ব্যক্তি। অভয় মাস্টার বলতেন, এই যে মুখরোচক সনদপ্রাপ্তি—তা মাকাল ফলের মতো। দৃষ্টিনন্দন হলেও গলাধঃকরণে অযোগ্য। তিনি শিক্ষাহীন সনদসর্বস্ব শিক্ষার ভবিষ্যৎ কল্পনা করে আতঙ্কিত হয়ে উক্ত সংস্কৃত শ্লোক শোনাতেন।

চকচকে দৃষ্টিনন্দন সনদ বাগিয়ে এখন কর্মসংস্থানের জন্য দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা! শোনা যায়, প্রতিবেশী দেশে কয়েকটি পিয়নের চাকরির জন্য প্রায় চার হাজারের মতো পিএইচডি ডিগ্রিধারী আবেদন করেছেন। আর আমাদের দেশ ওই ধরনের চাকরির জন্য লাখ লাখ স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর মিছিল। পশ্চিমাদের অনুকরণে আমাদের শিক্ষাসম্ভ্রমের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা হারাতে বসেছি। সৃজনশীলতার জ্বালা আর জিপিএর পালা আমাদের সর্বনাশা করছে। মনে রাখা দরকার, শিক্ষা অটোমেটিক মেশিনে বেরিয়ে আসা সামগ্রী নয়, হস্তশিল্পের কারুকাজের মতো সেখানে গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন। যারা সৃজনশীলতা শেখাবেন, তাদের অনেকেই তা বোঝেন কি না সন্দেহ। দু-একজন যাঁরা গোঁজামিল দিয়ে শিখেছেন, তাঁরা গাইডের ব্যবসা খুলেছেন। আর তথাকথিত কিছু শিক্ষক ও ‘ভাইয়া’ সেগুলো সংগ্রহ করে পড়ানোর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর কোচিংয়ে শিক্ষার্থীদের বদহজমের ব্যবস্থা করছেন। শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পাচ্ছে ঠিকই, তবে ভর্তি পরীক্ষায় প্রবল ধাক্কা খাচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষা নামের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মূলধন স্ফীত করছে। অনেকে মনে করেন, এই এ প্লাস অনেকটা এ ক্রসের মতো। প্লাসের চিহ্নটা একটু বাঁকিয়ে লেখলে ক্রসের মতো দেখায়। সাধারণ অর্থে যাকে আমরা বাতিল বলি।

বাংলা ভাষার পথ ধরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। অথচ ১৯৭৫-এর জাতীয় ট্র্যাজেডির পর ঘরে ঘরে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা শুরু হয়ে গেল। কৃত্রিম অভিজাতরা তাঁদের সন্তানদের ইংরেজি, যা না শেখানোর জন্য উদ্বাহু হয়ে পড়লেন। কে পড়াবে ইংরেজি মাধ্যম পাঠক্রম? শিক্ষাদাতা স্বয়ং অক্ষম। শিক্ষার্থীকে তিনি কী শেখাবেন? ফলে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বর্ণমালার আঁকজোখ কাটলেই এ প্লাস পেয়ে যায়। এসব দুর্ভাগার কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠাঁই হয় না। তারাও বাহারি নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে সাহায্য করছে। যদিও পরিণাম আশাপ্রদ নয়। এই দুষ্টচক্রের রাশ টেনে ধরতে হবে কঠিনভাবে। না হলে আমাদের একটা প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে অচিরে।

শোনা যাচ্ছে, ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি নিয়ে নড়াচড়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে অনায়াস চাকরি পাওয়া কিছু ব্যক্তি এর সমালোচনায় মুখর। শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে মতবাদী-সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর খপ্পর থেকে রক্ষা করতে হলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ প্লাস, প্রথম শ্রেণি, পিএইচডি ইত্যাদি যেন শিক্ষকতাপ্রাপ্তির মানদণ্ড না হয়। মাকাল ফলের মতো ব্যক্তিদের শিক্ষকতার পবিত্র বেদিতে অধিষ্ঠিত করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস করা যায় না।

শিক্ষকতায় কোনো কোটা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানেই নির্মোহ দৃষ্টিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া উচিত। তাঁরা দলীয় কিংবা মতবাদী হবেন না, হবেন জাতীয়। জাতির মান রক্ষা ও উন্নতিতে যেন অবদান রাখতে পারেন, তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। দুর্ভাগ্য আমরা বহুজাতিক, অন্য জাতির কর্মকাণ্ডকে আমরা নিজেদের ভাবছি এবং তা শিক্ষার্থীদের মগজে প্রবিষ্ট করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ প্রবণতা অবশ্যই বর্জনীয়।

মানবমুক্তির বিশ্বাস যার অন্তরে তিল পরিমাণ নেই, তাকে দিয়ে আর যা-ই হোক, শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হলে জাতির মেরুদণ্ড সোজা হবে না। শিক্ষক হবেন প্রগাঢ় মনুষ্যত্বের অধিকারী, নৈতিকতায় ইস্পাতকঠিন এবং তাঁর লব্ধজ্ঞান হবে অবিমিশ্র। পরিতাপের বিষয়, আমরা এসব লক্ষণের তীব্র সংকটে অবস্থান করছি।

আমরা বহুবার বলেছি, শিক্ষক শিক্ষক হয়েই জন্মায়। তারা প্রবৃত্তির হাতছানিকে দূরে সরিয়ে কঠিন সংযমের বন্ধনে নিজেকে পরিবৃত্ত রাখবেন। মনে রাখা ভালো, ভালোবাসা চুক্তির বিষয় নয়। শিক্ষাকে ভালোবেসে যাঁরা শিক্ষকতায় আসেন, তাঁরা দেনদরবারে থাকেন না। এখন দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই চুক্তি আর দেনদরবারের পালা। কোনো রকমে শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখাতে পারলে অনায়াস জীবিকা নিশ্চিত। অবশ্য এঁদের পক্ষে দরদি উপদেশক কম নেই। এটা জানা সত্ত্বেও যাঁরা শিক্ষকতায় এসেছেন, তাঁরা শিক্ষাকে ভালোবেসে নয়; বরং তুলনামূলক সহজ কর্মসংস্থানের জন্য এসেছেন। এঁরা সমাজকে এবং জাতিকে নৈতিকতার আদর্শে উজ্জীবিত করবেন কিভাবে। এঁরা অনেকটা মাকাল ফলের মতো। যেন মধুজিহ্বাগ্রেতুষ্টি প্রবচন।

আমরা বলছিলাম শিক্ষার প্রতি ভালোবাসার কথা। সেই শিক্ষাবান্ধব শিক্ষকদের প্রতি সরকারের ন্যায় দৃষ্টি রাখতে হবে। তা যেন প্লেটনিক না হয়। প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার আছে। সত্যিকার শিক্ষক সমাজে সম্মানের পাত্র। তাঁরা যেন তাঁদের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করতে পারেন, সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে। তবে আমরা মনে করি, মাকালদের জন্য জনগণের অর্থ ব্যয় সমীচীন কি না তা ভেবে দেখা দরকার।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0078048706054688