হালে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বেশ সরব। তিনি বাংলাদেশে শিক্ষায় বড় পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছেন। এ জন্য ২০১০ সালের শিক্ষানীতি সংস্কারের কথা বলছেন। বলছেন, দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলার কথা। বলছেন, কেরানি তৈরির শিক্ষায় তিনি ইতি টানবেন এবং চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার বিকাশ ঘটাবেন। মোটা দাগে শিক্ষামন্ত্রীর চিন্তা বাজারমুখী। সে বাজার আবার শুধুই দেশে সীমাবদ্ধ নয়; তাঁর কথাবার্তায় আভাস মিলছে, তিনি বিশ্ববাজারের কথা ভাবছেন। বাজারে যে ধরনের দক্ষ জনশক্তির চাহিদা আছে বা বাড়ছে বা আগামী দিনে যেমন চাহিদা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে; তিনি তেমন শিক্ষাপরিকল্পনা করতে চান। তিনি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছেন বেশ জোরেশোরে। তাঁর এ চিন্তা আলোচনার দাবি রাখে। সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, শিক্ষামন্ত্রীর কথাবার্তায় স্পষ্ট হচ্ছে যে তিনি ২০১০ সালের ঢাকঢোল পেটানো জাতীয় শিক্ষানীতিতে আস্থা রাখতে পারছেন না। তাঁর মতে, ইতিমধ্যে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে এবং অতিদ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে এ শিক্ষানীতি কার্যকারিতা হারিয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি বলে পরিচিত ২০১০ সালের শিক্ষানীতি চমৎকার কথামালার এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার চেয়ে বড় কথা, এই শিক্ষানীতির বনিয়াদ বাস্তবায়নের সামান্য প্রয়াসও জাতি লক্ষ করেনি। অথচ এটি বাস্তবায়নে সরকার সময় পেয়েছে গোটা এক দশক এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নিজে সময় পেয়েছিলেন ৯ বছর। ইতিহাসে এত দীর্ঘকাল কেউ শিক্ষামন্ত্রীর পদে থাকার নজির নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে পাস হওয়ার পর দীর্ঘ আট বছরেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ শেষ করতে পারেনি। শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের দেওয়া কোনো অঙ্গীকারই পূরণ হয়নি। তবে বছরের প্রথম দিনেই কয়েক কোটি শিশুর হাতে পাঠ্যবই তুলে দিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত প্রশংসার কাজটি করেছেন। এ জন্য জাতি তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই জাতীয় শিক্ষানীতি সামান্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষা যেমন আট বছর মেয়াদি হয়নি, তেমনি মাধ্যমিক শিক্ষাও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা যায়নি; বাদ দেওয়া হয়নি উচ্চমাধ্যমিকের মধ্যবর্তী স্তর। এ কাজে সামান্য কোনো পদক্ষেপও জাতি লক্ষ করেনি। চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স প্রান্তিক শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি এবং জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী আরও এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য পেরেশান হয়েছেন।
সরকারি, বেসরকারি কর্মখালি বিজ্ঞাপনেও চার বছরের অনার্স ডিগ্রিকেই যথাযথ বলে ঘোষণা করা হয়নি। অর্থাৎ সরকার নিজেই তার শিক্ষানীতি মানেনি বা কার্যকর করেনি। ফলে সাধারণ জনগণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। শিক্ষা আশ্রয় পেয়েছে কোচিং আর নোট-গাইড বণিকদের পক্ষপুটে। অন্যদিকে পেশাভিত্তিক স্নাতক তৈরিতে নজিরবিহীন অবনমন সবাইকে পীড়িত করেছে। দক্ষ পেশাজীবীর অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ পূর্ণ হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে সর্বগ্রাসী।
জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাক্ষেত্রে আরও নানা সর্বনাশা নজির সৃষ্টি করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক হলো শিক্ষার্থী, বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের কাঁধে দুটি পাবলিক পরীক্ষার বোঝা চাপানো। এই শিক্ষানীতি প্রণয়নে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের একজন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি একাধিকবার লিখেছেন ও বলেছেন যে এই দুই পরীক্ষার সুপারিশ তাঁরা করেননি। কে বা কারা; কখন, কীভাবে এ দুটো পরীক্ষা এই শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তা এখনো রহস্যাবৃত।
শুধু তা-ই নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অনাবশ্যক বইয়ের বোঝা বাড়ানো হয় এবং শিক্ষার্থীদের বিভাজিত শিক্ষার ঘেরাটোপে আটকে দেওয়ার মৌরুসিপাট্টা দেওয়া হয় এক শ্রেণির বিদ্যা বণিকদের। পৃথিবীজুড়ে যখন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সমন্বিত বা একমুখী শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে, তখন এই শিক্ষানীতি শিক্ষার্থীদের খণ্ড খণ্ড শিক্ষার দিকে ঠেলে দেয়। শিক্ষা যখন জীবনদক্ষতা অর্জনের কৌশল, তখন জাতীয় শিক্ষানীতি তত্ত্বের কচকচানি শেখাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কাজেই জাতীয় শিক্ষানীতি আমাদের অগ্রবর্তী শিক্ষার দলিল না হয়ে, তা আমাদের আরও পেছনে ঠেলে দিয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও বেতন স্কেল দেওয়ার মূলো দেখানো হয়েছিল। কার্যত, শিক্ষকদের মর্যাদাহানির সবচেয়ে পীড়াদায়ক ঘটনা ঘটেছে এই শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার পর। স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি, কলেজে গভর্নিং বডির দৌরাত্ম্য না কমিয়ে বৃদ্ধি করা হয় এবং বিকল্পহীন একদলীয় দুঃশাসন চাপানো হয়। মুক্তবুদ্ধির পথ চিররুদ্ধ করা হয়। শিক্ষকদের আমলাদের অধস্তন সেবক হিসেবে অধঃপতিত করা হয় এবং পদে পদে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়েছে। এ সময়ে শিক্ষক সমাবেশগুলোতে শিক্ষকদের যে ভাষায় অপমান করা হতো, তার কোনো নজির আগে ছিল না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয় এবং আমলারা অবাস্তব সব নিয়মবিধি বেঁধে দিয়ে শিক্ষক সম্প্রদায়কে ঠেলে দেন রাজপথে। ফলে বারবার বাধাগ্রস্ত হয় শিক্ষা কার্যক্রম। দীর্ঘ এক দশকে শুধু আশ্বাসবাণী শোনানো হয়েছে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আগে কখনো এত দীর্ঘকাল ধরে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, পুলিশের লাঠিপেটা আর কাঁদানে গ্যাস খেয়ে এ দেশের শিক্ষকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু ফলাফল হয়েছে শূন্য।
এখন শিক্ষামন্ত্রী উপলব্ধি করছেন যে জাতীয় শিক্ষানীতি আদৌ যুগোপযোগী নয় এবং তার সংস্কার আশু জরুরি। তাঁর উপলব্ধির সঙ্গে শিক্ষানুরাগী অনেকেই সহমত পোষণ করবেন। তবে সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির প্রণেতা মেকলের যুগ থেকেই শিক্ষায় ‘চুঁইয়ে পড়া তত্ত্ব’ চালু রয়েছে। এবার কি তার উল্টোটা ঘটবে?
করোনার কারণে এখন সভা-সেমিনারে ভাটার টান। না হলে গত পাঁচ মাসে শত শত সেমিনার হতো আর আমরা এন্তার জ্ঞানে স্ফীত কলেবর হতাম। বাংলাদেশে উন্নয়নের একটি নতুন ধারা চালু হয়েছে। এ মডেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোই নির্ধারণ করে উন্নয়ন প্রকল্প আর কর্মকৌশল। তারাই সরকারের কাছে দেনদরবার করে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা হাজির করে। এর চটকদার ও নজরকাড়া নজির সৃষ্টি করেছে বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। বেশ কয়েকটি বড় দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর পাবলিক জানতে পেরেছে, সব কটিতেই কলকাঠি নেড়েছে গুটিকয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যখাতে তা অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী যে সংস্কার জরুরি বিবেচনা করছেন, তাতে অনুগত কিছু লোক আর ঠিকাদারের পরিবর্তে এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণের আকুতি কতটুকু স্থান পাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান