প্রায় দু' সপ্তাহ ধরে দৈনিক শিক্ষায় কোনো লেখা পাঠাতে পারিনি। কেন জানি অনেক ব্যস্ততার মাঝে সময় কেটে যায়। লিখি লিখি করে লেখা হয়ে ওঠেনা। এ নিয়ে কোনো কোনো পাঠক বন্ধু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ' স্যার ! কী হয়েছে ? এখন লেখেন না কেন ? লেখাটেখা ছেড়ে দিয়েছেন বুঝি ?' তাদের বিনয়ের সাথে বলি- লেখালেখির কাজটা ছেড়ে দেবার কোনো বিষয় নয়। যারা এ কাজ করে তারা জীবনে কোনদিন সেটি ছেড়ে দিতে পারেনা। লেখালেখি তাদের জীবনের একান্ত এক অনুষঙ্গ বিষয় হয়ে যায়। এটি বাদ দিয়ে আত্মাকে বাঁচানো কঠিন। সেটি আত্মার খোরাক। কেবল তাই নয়। নিজের বিবেকের কাছে নিজের জবাবদিহিতা ও বটে। তাই লেখালেখি এক অনিবার্য করণীয় কাজ। চলার পথের প্রিয়তম সাথী। তদুপরি, আমি নিজেও প্রিয় দৈনিকশিক্ষাডটকমকে দু'সপ্তাহ ধরে খুব মিস করছি।
আসলে শিক্ষা বিষয়ক এ অনলাইনটির প্রেমে দেশের লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মত কোনদিন থেকে যে মজে আছি সে কথা মনেই নেই। তবে এ কথাটি খুব মনে ধরে আছে যে, দৈনিক শিক্ষা পরিবার গত ক' বছর থেকে একান্ত কাছে টেনে অনেকের ন্যায় আমাকেও একান্ত আপন করে আগলে রেখেছে। সত্যি এর ভালবাসায় সন্দেহাতীত সিক্ত এখন। এ ভালবাসা অনিমেষ। ঠিক যেন লাইলি-মজনুর প্রেম। ইউসুফ-জুলেখার ভালবাসার মত। ছোটবেলা বাবাকে ইউসুফ-জুলেখার পুঁথি সুর ও ছন্দে উচ্চস্বরে পড়তে শুনেছি। পয়ার ও ত্রিপদি ছন্দে বাবা যখন দরাজ গলায় পুঁথি পড়তেন তখন গ্রামের বহু মানুষ তাকে ঘিরে বসে পুঁথি পড়া শুনতো। তখন লাইলি-মজনু কিংবা ইউসুফ-জুলেখা প্রেমের উপাখ্যানটুকু না বুঝলেও বাবার পয়ার ও ত্রিপদি ছন্দের পুঁথি পাঠের মজাটা বেশ উপলব্ধি করতাম। এখন তাদের প্রেমের মাহাত্ম্যটা বুঝি। সে সাথে বাবার পুঁথি পড়ার কায়দাটাকেও আজ বড় বেশি মিস করি।
সিলেটি নাগরি ভাষায় লেখা 'হালতুন্নবী' পুঁথিটি ও বাবা মাঝে মাঝে সুর করে পড়তেন। আমার একমাত্র ফুফু ও নাগরি হরফে লেখা এ পুঁথিটি পড়তে পারতেন। এটি তার এক রকম মুখস্তই ছিল। নাগরি আসলে পৃথক কোন ভাষা নয়। বাংলা ভাষার আলাদা রকমের কতকগুলো অক্ষর বা বর্ণ। এগুলোকে নাগরি বর্ণমালা বলাই সমীচিন হতো। সে কেবল সিলেট অঞ্চলে। এটিকে অনেকে সিলেটি নাগরি বলে থাকেন। কেবল বাংলা ভাষার অক্ষরগুলোর অন্য এক ভিন্নরুপ। বাবা ও ফুফু দু'জনেই বহু আগে পরকালগামী হয়েছেন। তাদের দু'জনকেই আজ বড় বেশি মনে পড়ে।
আসলে পুঁথি সাহিত্যের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের সুচনা। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন 'চর্যাপদ' ও মুলতঃ পুঁথি সাহিত্যের এক অপুর্ব সম্ভার। এখন আর গ্রাম বাংলায় কাউকে পুঁথি পড়তে শুনিনা। সিলেটি নাগরি অক্ষরগুলো ও এখন বিলুপ্তির পথে। সব মিলিয়ে দিনে দিনে আমাদের অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। সে সব বাঁচানোর উদ্যোগ কারো নেই।
আজ ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন। জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ। নতুন বছরে নানাজনের নানা প্রত্যাশা। দৈনিক শিক্ষার অগণিত পাঠকদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমিও একটি ছোট্ট সামষ্টিক প্রত্যাশার কথা নিয়ে লেখাটি শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার এক বড় দোষ। অন্যে জানে কীনা জানিনা। কিন্তু আমি ভালো করেই জানি। সেটি ভাষার মুদ্রাদোষ। মুলতঃ ভাষার নয়।দোষটি কথকেরই। তবু ভাষার নামে দোষটি আমরা চালিয়ে দেই। সে দোষের কারণে ভাষার খেই হারিয়ে যায়। কী বলতে কী বলা হয় ? ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অবস্থা। যাক এবার অন্য কথায় যাই।
গতকালই গত হওয়া পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে নানা ব্যস্ততার সাথে যোগ হয়েছিল সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেটি নিয়ে যেমন কৌতুল ছিল তেমনি শংকা ও একেবারে কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে এ নির্বাচন একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের নতুন প্রজন্মের উদ্যমের কারণে সে চ্যালেঞ্জটি অতিক্রম করা গেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কেবল অন্যের মুখে শুনেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেশি তাড়িত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। নতুন ও পুরাতনের মাঝে এ পার্থক্যটি সুস্পষ্ট দেখতে পাই। আমি তাই খুব আশাবাদি হয়ে উঠি যখন দেখি নতুন প্রজন্মের ছেলেপিলেরা মুক্তিযুদ্ধ না দেখেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে উঠছে। এ চেতনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ তাদের মানসিকতা। এ দেখে কবির সে অনবদ্য কবিতার পংক্তিগুলো বার বার মনের অজান্তে উচ্চারিত হতে থাকে-সাবাস বাংলাদেশ/অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে ছারখার / তবু মাথা নোয়াবার নয়। নতুন বছরের নতুন দিনে এ প্রত্যাশাটি আমাদের সবার অন্তরে গেঁথে যাক।
বিজয়ের মাসের শেষ দিনটিতে অর্জিত আরেক বিজয় আমাদের আরো বেশি প্রত্যয়ী করে তুলুক। নতুন প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাসে আরো বলীয়ান করুক। আজকের এ দিনে এর চেয়ে বড় প্রত্যাশা নেই। স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর কতবার আঘাত এসেছে- সে হিসেবটি সঠিক করে ক'জনে জানে ? জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ আর কোনদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে-সে অনেকে ভাবতেই পারেনি। একজন শেখ হাসিনার কারণে বাংলাদেশ আজ ঠিকই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। সত্যি,অবাক পৃথিবী তাকিয়ে দেখে বাংলাদেশের তর তর এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। অদ্যম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভাগ্যিস বলতে হয়। শেখ হাসিনা পঁচাত্তরে বেঁচে গিয়েছিলেন বলে বাংলাদেশটা আজো বেঁচে আছে। শেখ হাসিনা বেঁচে না থাকলে বাংলাদেশের আজ কী হতো ? কোথায় হারিয়ে যেত আমাদের সোনার স্বাধীনতা ? শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হ্যাট্রিক জয় অর্জন করে চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হতে চলেছে। সঙ্গত কারণে এখন শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রত্যাশা ও বহু গুণ। বাংলাদেশে একটি শিক্ষা বিপ্লব ঘটিয়ে দেবার এখনই উপযুক্ত সময়। সে বিপ্লবটি শেখ হাসিনার মাধ্যমেই সম্ভব। সেটি আজ কেবল শিক্ষকরাই নন সারা দুনিয়া জেনে গেছে। শেখ হাসিনা যেটি পারেন সেটি অন্যে পারেনা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা সারা পৃথিবীকে শুধু অবাক করেননি। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সকলে ভেবেছিল বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেবেনা। ঠেলে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।
শেখ হাসিনা বলেছেন, "আমরা খেলে, ওরাও খাবে।"এখন সারা দুনিয়া বলে "শেখ হাসিনা মানবতার নেত্রী। মাদার অব হিউম্যানিটি বেসরকারি শিক্ষক সমাজ নতুন জাতীয় বেতনস্কেলের আগে সরকারের দেয়া মহার্ঘ্য ভাতা পাবেন কি পাবেন না সে নিয়ে যখন দোলাচলে ছিলেন তখন শেখ হাসিনা পরম মমতায় হাত বাড়িয়ে দেন। যখন নতুন জাতীয় স্কেলে বেতন পাবেন কি পাবেন না এমন আশংকা দেখা দেয় তখন শেখ হাসিনা এগিয়ে আসেন। পাঁচ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি আর বোশেখি ভাতা পাবার আশাটুকু একেবারে নিরাশ হয়ে যখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলেন তখন শেখ হাসিনা কোন রাখঢাক না করেই ইনক্রিমেন্ট ও বোশেখি ভাতা দিয়ে সারা দেশের পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীদের হতাশার অবসান ঘটাতে ভালবাসার পসরা সাজিয়ে এগিয়ে আসেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মানবতার নেত্রী। আপনি শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব নেত্রী হিসেবে সারা দুনিয়ায় অনন্য। আপনি অদ্বিতীয়। বার বার আপনার জয় হউক। এ জয় বাঙ্গালির। এ জয় বাংলাদেশের মানুষের। এ জয় আমাদের অস্তিত্বের। জয়তু শেখ হাসিনা। প্রিয় পাঠক, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সর্বশেষ ছোট্ট প্রত্যাশাটির কথা আজ আর না-ই বললাম। আরেকদিন বলবো। সকলকে নববর্ষের অগণিত ও অফুরান শুভেচ্ছা দিই। বাংলাদেশ চিরজীবি হউক। আবারো জয়তু শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ চিরদিন বেঁচে থাকবেই।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।