শিক্ষাব্যবস্থায় কেন সৃজনশীলতার অভাব - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাব্যবস্থায় কেন সৃজনশীলতার অভাব

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আজকের দিনে গবেষণা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই কল্পনা করা সম্ভব নয়। একটু ভিন্নভাবে গবেষণার বিষয়টিকে আমরা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি। এজন্য দরকার পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটি শিশু তার চারপাশের পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শিখতে থাকে। দিন যত গড়ায়, শিশুর শেখার আগ্রহ তত বাড়তে থাকে। গবেষণাও বলছে একটি শিশুর এই শেখার আগ্রহ দিনে দিনে তাকে নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকে। যা তার মধ্যে নানা ধরনের চিন্তার খোরাক জোগায়। এই যে ভিন্ন ভিন্ন ধারার চিন্তা করার ক্ষমতা এটাই সৃজনশীলতা। এই সৃজনশীলতা হচ্ছে গবেষণার মূল ভিত্তি। নাসার গবেষণা এই বিষয়ে বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছে। এই গবেষণাটি নাসার অধীনে থেকে ড. জর্জ ল্যান্ড ও বেথ জার্মান ২০১৭ সালে করেন। অনেকগুলো এলোমেলো প্রশ্ন থেকে এই গবেষণার সূত্রপাত। ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা কোথা থেকে আসে? ক্রিয়েটিভিটি কি জন্মগতভাবে আসে নাকি শেখার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এটি তৈরি হয়? নাকি ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি সৃষ্টি হয়? বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন  ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী।

বিষয়টির গভীরে যাবার জন্য গবেষকরা ৪ থেকে ৫ বছরের ১৬০০ শিশুদের ওপর গবেষণাটি চালিয়ে দেখতে পান সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ শিশু তাদের বিভিন্ন ধরনের নতুন ধারণা দিতে পারছে। গবেষকরা তাদের জিনিয়াস হিসেবে শনাক্ত করেছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে—একই গবেষকরা পাঁচ বছর পরে এই ১৬০০ শিশুর ক্রিয়েটিভিটি পরীক্ষা করতে গিয়ে যা দেখতে পেলেন তা তাদের হতাশ করল। জিনিয়াস শিশুদের সংখ্যা ৯৮ শতাংশ থেকে কমে ৩০ শতাংশতে এসেছে। আরো পাঁচ বছর পরে যখন সেই ১৬০০ শিশুর ওপর পরীক্ষা চালানো হলো তখন দেখা গেল এই সংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে ১২ শতাংশতে গিয়ে ঠেকেছে। গবেষণাটি বলছে আরো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিনিয়াসদের সংখ্যা কমে মাত্র ২ শতাংশে দাঁড়ায়। গবেষণাটি তাদের মূল উপসংহারে বলছে আমরা সৃজনশীল প্রতিভা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করলেও শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মেধাকে নিচে নামিয়ে দেয়। এই বিষয়টি বিশ্বজনীন।

গবেষণাটি বলছে মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীলতা কমে আসবে এটি ঠিক নয় বরং এই সৃজনশীলতাকে ধরে রাখার মতো শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের কী ধরনের ঘাটতি আছে সেটি বিশ্লেষণ করা দরকার। নাসার আরেক বিজ্ঞানী শিশুদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে এটি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখতে পান সেখানে ডাইভারজেন্ট এবং কনভারজেন্ট এই দুই ধরনের উপাদান কাজ করে। এখান থেকে তিনি মানুষের মস্তিষ্কের প্রকৃতিগত দিকটি বিবেচনায় এনেছেন। ডাইভারজেন্ট উপাদানটির প্রভাবে মানুষের মধ্যে নতুন ধারণা সৃষ্টি, কল্পনা শক্তির ব্যবহার, দর্শন ও ভিশন কাজ করে। অন্যদিকে কনভারজেন্ট উপাদানটির প্রভাবে মানুষ কোনো একটি বিষয়ে কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সমালোচনা ও মূল্যায়ন করছে এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। এখান থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো—ডাইভারজেন্ট চিন্তার প্রক্রিয়াটি আমাদের সৃজনশীলতাকে দ্রুত বাড়াতে থাকে। অন্যদিকে কনভারজেন্ট চিন্তার প্রক্রিয়াটি আমাদের বিশ্লেষণ করতে ও ভাবতে শেখায়। মস্তিষ্কের মধ্যে ক্রিয়াশীল এই দুটো প্রক্রিয়া বিবেচনা করে আমরা যদি শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে পারি তবেই সৃজনশীলতার মাধ্যমে মেধাশক্তিকে ধরে রাখা সম্ভব। তাহলে এই দুটো ভিন্ন চিন্তা ও মননশীলতার প্রক্রিয়াকে কীভাবে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি সেটি ভাবা যেতে পারে। একটি শিশু যখন গর্ভাবস্থায় থাকে তখন মায়েরা গান বাজনা, পিয়ানো বাজানো ও তাদের স্বামীদের সঙ্গে গণিতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকেন। গর্ভবতী মহিলাদের এই সময়ের সঙ্গী হয় বিভিন্ন ধরনের গণিতের বই। এর মাধ্যমে তারা শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় তাকে প্রশিক্ষিত করে তোলে। বিজ্ঞান বলছে একজন শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থা থেকেই শুরু হতে থাকে।

কেবল বিজ্ঞানের ধারণাকে এখানেই প্রয়োগ করা হয় না, খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে যে মেধাশক্তি বাড়ানো যায়, এ বিষয়টিও মায়েদের মধ্যে কাজ করে। এ সময় মায়েরা আলমন্ড খেজুর, দুধ, রুটি, কডলিভার, এবং অন্যান্য বাদামযুক্ত সালাদ খেয়ে থাকেন। প্রতিটি খাদ্যই কোনো না কোনোভাবে শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভূমিকা রাখে। এখানে মায়েদের সংগীতচর্চা ও তা শোনার কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের আধুনিক ধারণা বলছে, মানুষ যখন সংগীতচর্চা করে, তখন তার মধ্যে কোনো ধরনের মানসিক অস্থিরতা কাজ করে না। বরং এর পরিবর্তে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি তৈরি হয়। এছাড়া পিয়ানো বাজানোর মাধ্যমে সংস্কৃতির যে চর্চা মায়েরা করে থাকেন, তা শিশুর সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সংগীতের কম্পন মস্তিষ্কের কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে মেধার বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়া বিজ্ঞান, গণিত ও ব্যবসায় শিক্ষাকে জীবনমুখী করে শেখানো হয়, যাতে এগুলোর ফলাফল বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায়। খেলাধুলার সঙ্গেও শিশুদের সম্পৃক্ত করা হয়। বিশেষ করে দৌড়, ধনুবিদ্যা ও শুটিংয়ে যদি শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন বিজ্ঞানী জেফরি সি হল, মাইকেল রসবাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং বায়োলজিক্যাল ঘড়ির কর্মপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, আমাদের ব্রেইনে একটি মাস্টার ক্লক থাকে, যেটি নিয়ন্ত্রণে থাকে বায়োলজিক্যাল ঘড়ি। মেধা বা বুদ্ধির কয়েকটি স্তর রয়েছে। অনেক বছরের গবেষণা থেকে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোকের আইকিউ ১০০ থেকে ১১০-এর মধ্যে, যেটি একটি স্বাভাবিক অবস্থা। এই আইকিউ ১৩০-এর চেয়ে বেশি হলে মানুষ খুব বুদ্ধিমান হয়। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বিশ্বে ২.৫ শতাংশ। যখন এটি ১৪০ ছাড়িয়ে যায়, তখন মানুষ অসীম প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। বিশ্বে এ ধরনের মেধাবীর সংখ্যা মাত্র ০.৫ শতাংশ।

আমাদের আগামী প্রজন্মকে কীভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মেধাবী ও সৃজনশীলভাবে গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। কেবল বিজ্ঞান নয়, শিক্ষার বহুমাত্রিকতা, দর্শন ও সংস্কৃতির প্রকৃত চর্চার মাধ্যমেও মেধাশক্তিসম্পন্ন শক্তিশালী জাতি গঠনে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার প্রতিটি স্তরের প্রকৃতি অনুসারে সৃজনশীলতা সৃষ্টির এবং একে ধরে রাখার মাধ্যমে প্রকৃত সৃজনশীল প্রজন্ম তৈরির কাজ করতে হবে। শিক্ষার স্তরকে মাথায় রেখে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সেই স্তর অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষর্থীদের ধারণক্ষমতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। সৃজনশীলতা বৃদ্ধি ও তার সাস্টেইনেবিলিটির বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে পাঠ্যবইগুলোকে সহজবোধ্য করে লিখতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে সব স্তরের শিক্ষার মধ্যে ধারাবাহিকতা ও আনন্দের উপাদান থাকতে হবে। দেশের অবকাঠামগত উন্নয়নের দিকে আমরা নিজেদের এত বেশি যুক্ত করে ফেলেছি যে মানবিক উন্নয়নের মাধ্যমে সৃজনশীলতা ও মেধাচর্চার বিষয়টি ভুলতে বসেছি। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের আবার নতুন করে ভাবতে হবে। এর কারণ হচ্ছে, সৃজনশীলতা একটি দেশকে এগিয়ে নেয়।

 

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062320232391357