শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন : বিবেচনায় নিতে হবে অনেক কিছু - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন : বিবেচনায় নিতে হবে অনেক কিছু

মাছুম বিল্লাহ |

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচচমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বিবেচনায় নিলে এই পরিবর্তন অনেকটাই সমীচীন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরি করার পর পুরো শিক্ষক সমাজকে এরসাথে পরিচিত করাতে হবে। না হলে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কাঙ্খিতভাবে সম্পন্ন হয়না। তাড়াহুড়ো করে কিছু করলে যে তার ফল খুব একটা ভাল হয় না, তার  প্রমাণ আমরা কয়েকবার পেয়েছি।

শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসছে তাতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান না  অন্য কোন শাখায় পড়বে তা ঠিক  হবে একাদশ শ্রেণিতে। এর আগে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন দশটি বিষয় পড়তে হবে। বইয়ের সংখ্যাও এখনকার চেয়ে কমবে। বিষয়বস্তু বদলাবে। আর এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে, যার ভিত্তিতে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে দুটি পরীক্ষা হবে, এটি একটি ভাল প্রস্তাব। কারণ, প্রথম বর্ষে ঐচিছক সকল বিষয়ের প্রথম পত্র পড়ানো হয়, সেগুলোর ওপরে পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা সেগুলো ভালভাবে পড়বে। দ্বিতীয় বছরে দ্বিতীয় পত্র পড়ানো হয়, সেগুলোর ওপর আলাদা পরীক্ষা হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠক্রমের বই যাবে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নতুন পাঠ্যক্রমে নেয়া হবে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে, আর মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে ।২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে উচচ মাধ্যমিকে দুটো পাবলিক পরীক্ষা হবে।  নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোন পরীক্ষা থাকবেনা। এটিও চমৎকার প্রস্তাব। পরিমার্জিত এ শিক্ষাক্রম হবে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক।

তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নিয়ে কীভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা যায়, তা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা হয়নি। এরসাথে উচচ মাধ্যমিকে যে কয়টি বিষয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে হয়, সেগুলোই একাদশ ও দ্বাদশে ভাগ করে হবে। এসএসসির পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে।

পৃথিবীর অনেক দেশে  স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা, বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে বাস্তব জ্ঞান অর্জনে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়, পাঠ্যসূচির ব্যবহারিক অংশে সেগুলো সমাধানের উপায় সংযোজিত হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। এটি শুধু যে চালকের অদক্ষতা ও যানবাহনের ত্রুটির কারণেই সংঘটিত হচেছ তা নয়, পথচারীদের অসবাধানতা ও আইন না মানাও এর একটি বড় কারণ। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুকে রাস্তায় চলাচল ও পারপার, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলার পদ্ধতি রাস্তায় নিয়ে সরেজমিনে শেখানোর বিষয়টি প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ইদানিং বজ্রপাতে মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর মিডিয়ায় আসছে। বৃষ্টির দিনে বৈরি আবহাওয়ায় একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সারা দেশে ব্যাপক হারে মানুষ মারা যাচেছ। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিরাপদ ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে পাঠ্যসূচির মাধ্যমে। পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগে অবশ্যই দেশের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিতে হবে।

আমরা যদি বিগত ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই গড় পাসের হার ৮৪.৬৮ শতাংশ। এটি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আওতায় আনার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল। কেননা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশই তরুণ। তাদের যদি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশকে যে উন্নত দেশে পরিণত করার মহাপরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এ শিক্ষাব্যবস্থা টেকনোলজি বেজড নয়। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, আমরা যে ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা ভাবছি, সেটি বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আবার শুধু প্রযুক্তিনির্ভর করলেই হবেনা, শিক্ষিতদের মানবিক হতে হবে, তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে হবে। কাজেই কারিকুলাম তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। এটি হুট করে বা কয়েকজন মিলে তৈরি করলেই হবেনা। এখানে সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে করতে হবে। 

শিক্ষার বহুবিধ  সংজ্ঞার মধ্যে একটি হচেছ, Education is the process of facilitating  learning or the acquisition of knowledge, skill, values, beliefs and habits.  বর্তমান বিশ্বে ফর্মাল, ইনফর্মাল ও নন-ফর্মাল এই তিন ধরনের শিক্ষাই শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। শুধু বিদ্যালয়ে যাতায়াত করলে ও পড়লে পুরো বা আদর্শ শিক্ষা অর্জিত হয়না। মানুষ বিভিন্নভাবে শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। লার্ণিং বাই ডুয়িং পদ্ধতির প্রবর্তন এ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনেব বলে আমাদের বিশ্বাস।  
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসফর অন্যতম একটি অনুসঙ্গ। পাঠ্যসূচি মোতাবেক আহরিত তত্ত্বীয় জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ দেখানোর জন্য সাধারনত ওইসব সফরের আয়োজন করা হয়। এতে ওরা যা দেখল, বুঝল, শিখল ইত্যাদির ওপর কখনও এককভাবে, কখনও আবার গ্রুপ ভিত্তিতে সার্বিক মতামত,পর্যবেক্ষণসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়, উপস্থাপন করতে বলা হয়। এটি একটি বাস্তবধর্মী শিক্ষা। নতুন কারিকুলামে এ ধরনের বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সংযোজন করা উচিত। খেলার ছলে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা গেলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও কর্মে মনোেযোগী হবে। ফলে কোমলমতী শিক্ষার্থীরা সকল কাজ ও শিক্ষাকে উপভোগ্য হিসেবে গ্রহন করবে, কাজ ও মানুষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ জন্ম নেবে যা পর্যায়ক্রমে কাজ ও কাজের মানুষকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি থেকে ছেলেমেয়েদের বাইরে আনা সম্ভব হবে।
পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম এবং পুরনো শিক্ষাক্রম একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে গেলে তাড়াহুড়ো করে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হয়। এভাবে রচিত পাঠ্যপুস্তকের মান ভাল হয়না। কারিকুলাম পরিবর্তন বা পরিমার্জনের সাথে যারা জড়িত তাদের  এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। 

লেখক: মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040152072906494