শিক্ষার দৈন্য কাটিয়ে উঠতে হবে - Dainikshiksha

শিক্ষার দৈন্য কাটিয়ে উঠতে হবে

গোলাম কবির |

নীতিগ্রন্থের উদ্ধৃতি আর নানা মনীষীর উদাহরণ দিয়ে গালভরা উপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। অথচ ব্যক্তিজীবনে কার্যকর না করে উপদেশ খয়রাত শুধু হাস্যকর নয়, গর্হিতও। জেনেশুনে অন্তঃসারশূন্য এ কাজে আমরা সবাই অগ্রবর্তী। আমরা বুঝি না নৈতিকতার বক্তব্য দেওয়ার সময় সাধারণ শ্রোতা গড্ডলিকাপ্রবাহের মতো বুঝে না-বুঝে হাততালি দিলেও অনেকে মনে মনে বিদ্রূপের হাসি হাসে। সে হাসি বাইরে প্রকাশিত হলে পরিবেশ বিদীর্ণ হতো। এর মূল কারণ, আমরা নিজেকে জানি না বা জানার জন্য সময় নষ্ট করার সময় নেই।

জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানবচিত্তের আদি চেতনা হলো নিজেকে জানা। নিজের মনের আয়নায় নিবিষ্টভাবে নিজেকে দেখলে বোঝা যায় মানবপ্রবৃত্তির বিচিত্র রূপ। কোথা থেকে এলো কোথায় বা তার যাত্রা—বিষয়টি যদিও নিরবধি কালের, তবুও সেই স্বরূপের দ্বারস্থ হতে চায় না কেউ।

বিশ্বজোড়া মতবাদের উন্মত্ততা এবং ক্ষমতার শিখর স্পর্শের জন্য সংসারে এই যে বিপুল হানাহানি, সেখানেও নিজেকে জানার ব্যাপারে লুকোচুরি। কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তি ছাড়া উপদেশক নিজেই নিজের উন্নয়ন ছাড়া মানবকল্যাণের ধারেকাছে নেই।

চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সক্রেটিস নিজেকে জানার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতীয় দর্শনে নিজেকে জানার কথা বলা আছে। আরবিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু।’ অর্থাৎ নিজেকে জানলেই স্রষ্টাকেই জানা যায়।

মানবসভ্যতার সূচনা যুগ থেকে শিক্ষক ও ধর্মপ্রবর্তককে সমাজ-সংস্কারক হিসেবে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে মানুষ। যাদের উপদেশ-নিষেধকে শিরোধার্য জেনে জীবন পথে পরিচালিত হয়েছে। তখনকার দিনের স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ নিজের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য ও যাপিত জীবন সমান্তরাল।

বিশ্বজোড়া মূল্যবোধের পরিবর্তনের ধাক্কায় সেই বিশ্বাসের মূলে ফাটল ধরেছে। অনেকে মনে করেন এটা যুগের দোষ। আবার কেউ কেউ মনে করেন কালপ্রবাহ নির্মোহভাবে নিরন্তর অগ্রসরমাণ। মানুষের ভোগ ও ত্যাগের প্রবণতা মানবসৃষ্ট, কালের ধর্ম নয়। শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন তাঁদের ধারণা, শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত অনেকে নিষ্ঠ নন বলে শিক্ষার্থীদের অসদুপায়ে পরীক্ষা নামের বৈতরণি পার হওয়ার ফাঁকফোকর শিখিয়ে দেন। এঁদের কথায় ও কাজে বিস্তর ফারাক। শিক্ষার্থীরা খারাপ দিকটি অনুসরণ করে বলে সমাজে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

নিজের মনের গভীরে প্রবেশ করে আত্মানুসন্ধান করি না আমরা। স্বার্থের হানি ঘটলে শিক্ষার্থীকে মানসিক নির্যাতন করি। ফলে অনেকে অকালে ঝরে পড়ে। বিভ্রান্ত হয়। কেউ আবার আত্মঘাতী হওয়ার পথ বেছে নেয়। যেমন—অরিত্রী নামের এক কিশোরীকে মৃত্যু নামের কালো ছায়া ডেকে নিল। গত মে মাসে আমরা দেখেছি শিক্ষক নামের কলঙ্ক, জনৈক প্রতিষ্ঠানপ্রধানের উেকাচলিপ্সায় দেবাশীষ তার নামের ব্যর্থতা প্রমাণ করে উদ্বন্ধনে আত্মঘাতী হয়েছে।

আত্মদর্শনহীন শিক্ষকের সংখ্যা সমাজে কম নেই। এ জন্য মানবকল্যাণের দর্শন বিপরীতমুখী। নিকট অতীতে কোনো স্থানে একজন নিষ্ঠ ব্রতী শিক্ষক থাকলে তিনিই সমাজের মাথা হতেন। তাঁর আচরণ মানুষের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করত। শিক্ষকের বাড়ির পাশে নিজের বাড়ির পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করত। সে শিক্ষক নেই। নেই ধূলিমলিন মানুষকে মুক্তিদানের নিঃস্বার্থ সমাজকর্মী।

এখনকার বেশির ভাগ ধর্মীয় প্রতিনিধি, সমাজসেবী ও শিক্ষকের দৃষ্টি ক্ষমতা এবং বিত্তবৈভবের প্রতি। সম্প্রতি তুরাগ নদের তীরে ঘটে যাওয়া ঘটনা দূর ইতিহাসের ফোরাতকূলের মর্মান্তিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর সমাজসেবা অন্তঃপ্রাণ মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকের হলফনামায় জ্যামিতিক হারে সম্পদ বৃদ্ধির খবর পড়ে সচেতন মানুষ বিমূঢ়।

নিকট অতীতে শিক্ষাগুরুদের সাদরে আহ্বান জানানো হতো। আর সমাজসেবকদের নির্মোহ কর্মকাণ্ডে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই জনগণ তাঁদের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করতেন। শিক্ষকতার উমেদারদের পদলেহনে এখন পদধূলি পাওয়া কঠিন আর সমাজসেবীদের সেবা করার সুযোগ প্রাপ্তির প্রার্থনা দেখে পঞ্চতন্ত্রের কিছু হিতোপদেশের আবরণে যে ভোগলিপ্সার কদর্যতা, তা আবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

গাড়ি-ঘোড়া আর সুরম্য প্রাসাদ কোনো জাতির মানসিক ঐশ্বর্যের পরিচায়ক নয়। কিছু দেশ আছে যারা প্রাকৃতিক সম্পদের বলে বলীয়ান। সম্পদ শেষ হলে তাদের অবস্থা পুরনো বস্ত্রখণ্ডের মতো হতে বাধ্য। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বাইরের ঐশ্বর্যের দিকে। তবে মানসিকভাবে আমরা দীন হয়ে পড়ছি। কী শিক্ষায়, কী জনসেবায়। এই দীনতা আমাদের অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে হবে। নতুবা এত দিনের যা কিছু অর্জন, ম্লান হয়ে যাবে। কে জানে, আত্মদর্শনের মানবিক জীবনাচরণের প্রাপ্তি কত বিলম্বিত হবে! মানসিক উৎকর্ষের বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে পারলে হয়তো আমরা বলতে পারব প্রকৃত সভ্যতার সিংহদ্বারে পৌঁছে গেছি।

আত্মতুষ্টি নয়, সমাজের সামগ্রিক তুষ্টির কথা ভেবে নিজেকে জানতে পারলে মানবমুক্তি আপনি এসে ধরা দেবে। তাই আমরা বলতে পারি আত্মদর্শন মানবমুক্তির অভ্রান্ত সোপান।

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067009925842285