শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের পথে আমরা প্রতিনিয়ত চলছি, তা না হলে হাল আমলের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা আমরা ভোগ করছি তা হয়ত জুটতো না। আজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নতুন নতুন বিষয় চালু হচ্ছে মানুষের চাহিদা থেকে।
আমরা জানি শিক্ষার নানা স্তর আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদরাসা, উচ্চ শিক্ষা ইত্যাদি। এদেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় পার করছে শিক্ষা অর্জন তথা জ্ঞান অর্জনের পিছনে। এটার একটা উদ্দেশ্য আছে। এ উদ্দেশ্যটা ছোট থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত।
কিছুটা ব্যাখ্যায় গেলে বলতে হয় জ্ঞান অর্জন, সার্টিফিকেট অর্জন, ভবিষ্যতে সম্মানজনক চাকরি পাওয়া, পরিবার, সমাজ ও দেশকে কিছু দেওয়া সেই সাথে নিজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ।
স্কুল জীবনে আমি একটা ট্রান্সলেশন পড়তাম। সেটি হল, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। ইংরেজিতে বলতে হয়, 'Education is the backbone of a nation'। ট্রান্সলেশনটা সহজে পড়ে ফেললেও ‘মেরুদণ্ড’ শব্দটিকে ঘিরে মনে একটা খটকা তৈরি হতো। কারণ বিজ্ঞানে পড়েছিলাম মেরুদণ্ডি প্রাণি আর অমেরুদণ্ডি প্রাণি। যাই হোক, পরবর্তিতে যতই উপরের ক্লাসে উঠেছি ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ বাক্যটি আমার কাছে খোলসা হয়েছে।
আজকাল আমরা প্রায়ই বলে থাকি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একদিন দেশের হাল ধরবে। এদেশকে তারা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তারাই এদেশের মেরুদণ্ড।
এটাও ঠিক মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হলে শিক্ষা অর্জন করতে হবে, জ্ঞনী হতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি পড়ালেখা বিমুখ না পড়ালেখামুখী?
দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো থেকেই হয়তো এর কিছুটা ধারা পাওয়া যায়। কেননা প্রতিবছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় সারাদেশে অংশগ্রহণকারী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা থাকে প্রায় ৩০ লাখের কাছাকাছি। পরবর্তিতে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে কমতে থাকে।
এ পরিসংখ্যান থেকে থেকে এটি প্রমাণিত যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে। তাহলে নতুন প্রজন্মের সকলেই পড়ালেখামুখী এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যায় না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা বলে থাকেন, ‘শিক্ষা অর্জনের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে আগে একটি উপযোগী শিক্ষার পরিবেশ দিতে হবে’। সেটি বিদ্যালয়ে যেমন, বাসাবাড়ির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। পণ্ডিতরা বলে থাকেন, ‘জ্ঞান অর্জন একটি সাধনার ব্যাপার’। শিক্ষা অর্জন একটি নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। হঠাৎ কেউ পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পরবর্তিতে মনোসংযোগ বসানো অত্যন্ত কঠিন কাজ।
তবে এটাও ঠিক বর্তমান সমাজে আমরা যে নানারকম উপসর্গ দেখতে আমাদের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় প্রতিনিয়ত ব্যঘাত ঘটিয়ে চলছে। আমরা যখন বিদ্যালয়ে পড়তাম তখন একটি মাত্র টিভি চ্যানেল ছিল বিটিভি। সেখানে বিনোদন বলতে ছিল একটিমাত্র সাপ্তাহিক নাটক এবং মাসে একখানা সিনেমা। নাটক ও সিনেমাগুলো ছিল শিক্ষামূলক ও জীবনঘনিষ্ঠ।
সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বে বাসায় ফিরে রুটিন মতে রাতের পড়ালেখা করে তবেই মিলত নাটক দেখার অনুমতি। আর ঘরে ঘরে আমাদের পড়ালেখা চলত আওয়াজ করে। পাড়া মহল্লায় পড়ালেখা নিয়ে চলত তুমুল প্রতিযোগিতা। বর্তমানে শিশু শিক্ষার্থীদের শব্দ করে পড়ালেখার রেওয়াজটা যেন তেমন একটা চোখে পড়ে না। বরং অনেক মা বাবাকে দেখা যাচ্ছে তাদের শিশু সন্তানটির হাতে ট্যাব, মোবাইল, কিংবা ভিডিও গেমসের কোন উপাদান ধরিয়ে দিতে।
অন্যদিকে এখনকার সময় আমরা দেখছি বিটিভিসহ অনেক অনেক টিভি চ্যানেল। অর্থাৎ আমরা একটা আকাশ সংস্কৃতির যুগে বসবাস করছি। বিনোদনের যেন কোন কমতি নেই। আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার সময়টাতে কোন চ্যানেল দেখবে সেটিই ঠিক করতে পারছেনা। ঘুড়েফিরে না হয় নাটক দেখা না হয় সিনেমা দেখা। এগুলোর মাঝে আবার আছে বিজ্ঞাপনের জ্বালাতন। সিনেমাও দেখা যাচ্ছে কেবল সাকিবময়। ইদের মৌসুমে সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, কোনটি আবার লাইভ প্রচার। ঘরে ঘরে টিভিতো আছেই। তাহলে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখাটা করবে কখন।
এই বয়সে স্বাভাবিকভাবে তাদের বিনোদনের দিকে ঝোঁক থাকে। ছোটবেলায় রচনায় পড়ছিলাম ছাত্রজীবন ভবিষ্যত জীবনের বীজ বপনের সময়। আমাদের কয়জন ছাত্র এই কথিকাটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে এটিও আজ একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন। কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমাদের শিক্ষার্থীদের রয়েছে সরব পদচারনা। এটিও তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। দিনে রাতে এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে ছাত্রজীবনের মূল্যবান সময় অপচয় করছে তারা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতে দেখা যাচ্ছে টাচ বা স্মার্ট মোবাইল। সেই উদ্দেশ্যে (যোগাযোগের জন্য) এটি কেনা হয়েছিল কদিন বাদেই দেখা যাচ্ছে কথায় ও কাজে মিল থাকছেনা। ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কথায় ও কাজে মিল থাকছেনা। ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিযোগীতা। যার যত বেশী বন্ধু তার তত গর্ভ। আমার পরিচিত অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রও নাকি বিরাট বড় স্টার। কেননা তার নাকি সারা বিশ্বে অনেক ফেসবুক বন্ধু আছে। ফেসবুকে তার একটি ছবিতে প্রায় হাজারের কাছাকাছি লাইক পড়ে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তারা (শিক্ষার্থী ) ফেসবুকে নিজেদেরকে অনেক বিজ্ঞ, জ্ঞানী, গুনি বোঝানোর চেষ্টা করছে। নায়কোচিত ছবি দিচ্ছে , নানান মন্তব্য করছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবার বানানে ভুল। বলা য্য় এই প্রজন্মের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ফেসবুকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এত করে তাদের রুটিন করে পড়ালেখার চর্চাটায় ( যা তাদের মূল কাজ) মারাত্নক বিঘ্ন ঘটেছে।
পৃথিবীর সেরা ধনি ব্যক্তি বিল গেটস এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তিনি তার মেয়েকে ১৮ বছর হওয়া না পর্যন্ত স্মার্ট মোবাইল কিনে দেননি। এ থেকেও বোঝা যায় স্মার্ট মোবাইল শিক্ষার্থীদের জন্য হিতকর নয়। একটি দেশের দ্রুত উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই শিক্ষা অর্জনের প্রচেষ্টায় সকলকে শরিক থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা শুধু পুথিঁগত বিদ্যা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবেনা, সৃজনশীল নানারকম কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকতে হবে। প্রতিনিয়তই জ্ঞানের চর্চা বাড়তে হবে। তবেই তাদের দৃষ্টিতে ভালো মন্দের পার্থক্য সহজেই ধরা পড়বে। ছাত্রজীবনেই নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ যেন যথাযথভাবে ঘটে সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই মহাবিশ্বের সীমাহীন জ্ঞার ভান্ডার সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জনের জন্য মহান প্রভুর কাছেই চাইতে হবে, “হে প্রভু আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও”।
লেখক : কলামিস্ট