বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এবং সমকালীন জীবন ও বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে দেশের স্কুলগুলোকে শান্তি নিকেতনের আদলে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার অনেক উপাদান যোগ করে এদেশের স্কুলগুলোর বিশেষ করে মাধ্যমিক স্কুলগুলোর উন্নয়ন সম্ভব। এমন সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বার ইতোমধ্যে উন্মোচিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মাধ্যমিক স্কুলগুলোর গুণগত উৎকর্ষ বিধানে কৃতিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (Performance Based Management) সংক্ষেপে PBM প্রয়োগের মাধ্যমে স্বপ্নের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সুফল পাওয়া গেছে। এমন অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর প্রয়াস হিসেবে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে PBM বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। শনিবার (৩১ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন প্রফেসর মো. শাহজাহান।
তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই শেষে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে দেশের ৫০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে PBM প্রবর্তনের পরিপত্র জারি করা হয়। অবশ্য দেশব্যাপী সকল মাধ্যমিক স্কুল এবং ৩৫টি মডেল মাদরাসাকে এ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে PBM পদ্ধতি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দেশে স্বপ্নের স্কুল প্রতিষ্ঠায় অভিযাত্রা শুরু হয়। কৃতিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বা পিবিএম পদ্ধতি প্রয়োগ করে স্বপ্নের স্কুল প্রতিষ্ঠা মূলত বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে গৃহীত রূপকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ। যদিও এ প্রচেষ্টা শিক্ষার বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণের বহু পূর্বে গৃহীত হয়েছে; তথাপি এ কর্মপ্রচেষ্টা শিক্ষার বৈশ্বিক অভীষ্ট অর্জনকে অনেকাংশে সহজ করে দিবে।
টেকসই উন্নয়ন সাধনে শিক্ষার যে বৈশ্বিক লক্ষ্য বা অভীষ্ট সেটা অর্জনে বিশেষ কিছু দক্ষতা ও যোগ্যতা স্কুল শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিকশিত করার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। যেমন— কার্যকর যোগাযোগ, সহযোগিতা (Collaboration), সূক্ষ্মচিন্তন, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং নেতৃত্বদানে সক্ষমতা। এসব দক্ষতা ও গুণাবলী আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য আগামীতে যে বিশ্ব অপেক্ষা করছে সেখানকার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারবে মর্মে প্রত্যাশা করা হয়েছে। পিবিএম স্কুলের আরও ভালো ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক সৃষ্টিতে নানাভাবে অবদান রাখবে। প্রথমত- প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত শিখন যোগ্যতা (Learning Competencies/outcome) অর্জনে নিজ নিজ স্কুলে কী কী সুবিধা থাকা দরকার, তা কতটা পরিমাণে আছে, ঘাটতি পূরণে স্কুলের পক্ষ থেকে করণীয় কী তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। দ্বিতীয়ত- কার্যকরী শিখন শেখানোর পদ্ধতির ধারাবাহিক উন্নয়ন। এক্ষেত্রে শিখন ও শেখানোর পরিবেশ সৃষ্টির যাবতীয় উপাদানের উপস্থিতি, পেশাদারিত্বের সঙ্গে শিক্ষকের কার্যসম্পাদন এবং শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব সঠিক পন্থায় মূল্যায়ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। তৃতীয়ত- স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল অংশীজনের (Stakeholders) সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। এর অংশ হিসেবে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে অভিভাবকদের যোগাযোগ রক্ষা, মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের শ্রেণি ও শ্রেণিবহির্ভূত সহ-পাঠে উদ্বুদ্ধ করা হয়। চতুর্থত- একাডেমিক পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা। এ কাজের মূল ভূমিকা স্কুল কর্তৃপক্ষের, বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকের। তার নেতৃত্বে এবং সংশ্লিষ্টদের কার্যাবলী, পরিবীক্ষণের ভিত্তিতে সমন্বয় সাধন, নির্দেশনা প্রদান এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা শুনে, দেখে এবং বিভিন্ন কার্যাবলীতে (Activities) অংশ নিয়ে প্রত্যাশিত যোগ্যতা ও গুণাবলী অর্জন করে। একইসঙ্গে সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম, যেমন—শরীরচর্চা, খেলাধুলা, নাচগান, আবৃত্তি ইত্যাদি যার যেটা পছন্দ তা বেছে নিয়ে চর্চা ও অনুশীলন করতে পারে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় DREAM SCHOOL বা স্বপ্নের স্কুল।
প্রফেসর মো. শাহজাহান : প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম।