নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঘিরে অনেক প্রত্যাশা তৈরি হলেও পরবর্তীতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি, এটি কেন?
সড়ক আন্দোলনের বড় তাত্পর্য এটাই, ছোট ছেলেমেয়েরা দেখাল যে তাদের মধ্যে মেধা ও ক্ষমতা রয়েছে, তারা ব্যবস্থা করতে পারে, তারা ট্রাফিক সুন্দরভাবে ব্যবস্থা করতে পারছে। কেন পারছে? কারণ তাদের কোনো লোভ ছিল না। এ কিশোররা অপরাধ থামানোর জন্য গেছে, তাদের ব্যক্তিগত কোনো মুনাফালিপ্সা ছিল না। ব্যক্তিগত মুনাফার লোভের কারণেই সর্বত্র বিশৃঙ্খলা। এই যে ছেলেমেয়েরা বুঝেছে রাষ্ট্রের মেরামত দরকার, এ বোধটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সড়কের মেরামত, চালকের দোষ কিংবা বাস মালিকের দোষ এগুলোর চেয়ে বড় হচ্ছে রাষ্ট্রের দোষ। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তবে মেরামতে কাজ হবে না, রাষ্ট্রকে মৌলিকভাবে বদল করতে হবে। মেরামত বা সংস্কার করে এর কোনো উন্নতি হবে না।
দুর্নীতি দমনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা তো মেরামত করেই যাচ্ছি। তরুণদের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের আবশ্যকতার বোধ রয়েছে, কিন্তু তাকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সড়ক আন্দোলনের প্রভাব আরো বিস্তৃত হতে পারত, অন্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারত। কিন্তু থামিয়ে দেয়া হলো। দুর্যোগ হলে, মানুষ বিপদে পড়লে তরুণরাই সাড়া দেবে। কিন্তু তরুণদের উৎসাহিত করা হয় না। এ নিরুৎসাহিতকরণের একটি প্রক্রিয়া ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া। তরুণদের শুধু নিজ নিজ কথা ভাবার দিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে—বিসিএস পরীক্ষা দাও, গান-বাজনা, বিতর্ক কিংবা অন্যের সঙ্গে মেশার দরকার নেই। এ রাষ্ট্রের পরিবর্তন কীভাবে হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনার দরকার নেই, পাবলিক লেকচার শোনার দরকার নেই। আমি নয় বছর ডাকসুর ট্রেজারার ছিলাম। আমি দেখেছি ছাত্র সংসদ কতটা উপকারী। কিন্তু এগুলোতে উৎসাহিত করা হচ্ছে না।
তরুণদের মধ্যে মাদক ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
মাদক ভয়ংকর ঘাতক। অন্য অপরাধ থেকে বেরিয়ে আসা গেলেও মাদক থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্কর। এটি ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং এটি সংক্রামক। একজন থেকে আরেকজনের কাছে চলে যাচ্ছে। মূল কারণ হচ্ছে হতাশা। তরুণরা সৃষ্টিশীল কাজ পাচ্ছে না, কী করবে বুঝতে পারছে না। সে একা, বড় অসহায়, সে মুক্তি চায়; এ মুক্তি ব্যক্তিগত মুক্তি, সে সমষ্টিগত মুক্তির দিকে যেতে পারছে না। এ ছাত্ররাই কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে, ’৬৯ অভুত্থানে ছিল, এরাই ’৭১ সালে যুদ্ধ করেছে। আজকে সে যুদ্ধ নেই। ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে তারা সংগ্রাম করেছিল, এমনকি বাংলাদেশ আমলেও যখন স্বৈরশাসন ছিল তখন করল, কিন্তু আজকে সে যুদ্ধ নেই। আজকে যদি মতপ্রকাশের প্রসারিত ক্ষেত্র থাকত, তাহলে তরুণরা অনেক বেশি সংবেদনশীল হতো, মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাদের সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনশীলতা বাড়ত। ফলে কর্মের সংস্থানও হতো। তরুণরা একত্রিত হতে পারলে তারা কর্মসংস্থানও তৈরি করতে পারত, কিন্তু তাদের একত্রিত হতে দেয়া হয় না। বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহিত করা হয়।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সমস্যা কী বলে আপনি মনে করেন?
শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সমস্যা তিন ধারা। এটি দূর না করতে পারলে অন্য কাজগুলো অর্থহীন হবে। শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কী চাই? সামাজিক ঐক্য চাই, কিন্তু বর্তমান শিক্ষার তিন ধারা দ্বারা আমরা শ্রেণীবিভাজনকে আরো উৎসাহিত করছি, আরো বিস্তৃত করছি। বিত্তবান বা সুযোগপ্রাপ্তরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে, বাংলা মাধ্যমে যাবে মধ্যবিত্তরা এবং গরিবরা পড়বে মাদ্রাসায়। যুদ্ধের পরে আমাদের স্বপ্ন ছিল এক ধারায় নিয়ে আসব। সব শিক্ষা হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা হচ্ছে এক ধারায় না আনতে পারা। দ্বিতীয় সমস্যা, এ বিদ্যমান শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজিবাদী। আমরা যে মানুষ তৈরি করতে চাইছি, সে মানুষ মুনাফালোভী, সে মানুষ সামাজিক নয়। শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিকতার বোধ, সংবেদনশীলতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এগুলো উৎসাহিত হচ্ছে না। শুরুতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছিল ওই সেই স্থূল কথা— ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে।’ ওইটাই রয়ে গেছে। তুমি লেখাপড়া কেন করছ? গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার জন্য।
তুমি গাড়ি-ঘোড়ায় চড়বে, অন্যকে চাপা দেবে, সেখানেই তোমার শিক্ষার চরিতার্থতা। এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। কিন্তু এটা রয়ে গেছে। তুমি নিজের উন্নতির জন্য কাজ করছ। তুমি অন্য কোনো দিকে তাকাবে না। তুমি কেবল তোমার দিকেই তাকাবে। তোমার সাফল্যই তুমি চিন্তা করবে। বড়জোর পারিবারিক সাফল্যের কথা ভাববে। আর কারো কিছু হলো কি না হলো, তা নিয়ে তোমার মাথাব্যথা থাকবে না। ব্রিটিশ আমলে এ স্লোগান আমরা শুনতাম, পাকিস্তান হলো, বাংলাদেশ হলো, মানুষ প্রাণ দিল, ’৪৭ সালে মানুষ প্রাণ দিল, ’৭১ সালে আরো বেশি মানুষ প্রাণ দিল। আমরা গর্ব করে বললাম, ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটেনি। রাষ্ট্রের ভেতরের যে চরিত্র, তা আগের মতোই পুঁজিবাদী চরিত্র। রাষ্ট্র আবার আমলাতান্ত্রিক, সব ক্ষমতা আমলাদের হাতে। যারা ব্যবসা করছেন, তাদেরও আমলাদের ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ যে চলছে, তার বড় কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক। সুযোগগুলো নির্ভর করে আমলাদের সন্তুষ্ট করার ওপর।
ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা নিয়ে যে আলোচনা হয়, বাকি মাসগুলোয় তা অনুপস্থিত। ঘটা করে বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আমরা প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করতে পারছি না।
বাংলা ভাষায় জ্ঞানের উপযুক্ত চর্চা হচ্ছে না, জ্ঞানের বই লেখা হচ্ছে না। একুশের বইমেলা বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। প্রকাশকরা বই বিক্রি করতে পারবেন, যারা লেখেন তাদেরও বই বিক্রি হবে। তাদের খ্যাতি হচ্ছে। আবার যারা নিজের প্রচার চান, তারা নিজের খরচে বই বের করছেন। এভাবে শত শত বই ছাপা হচ্ছে। অথচ এসব বই ছাপার কোনো অর্থ নেই। সবটাই বাণিজ্যিক। বেচা এবং কেনা। এখানে জ্ঞানের কোনো দাম নেই। জ্ঞানের জন্য জায়গাটি খুব ছোট। মেলাটা টাকা উপার্জনের জায়গা হয়েছে। তবে যেটি আমি দেখি এবং যেটি আমার শুনতে ভালো লাগে তা হলো, প্রবন্ধের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। জানার জন্য একটা কৌতূহল তৈরি হচ্ছে, এটি একটি শুভ লক্ষণ। জ্ঞানকে নিয়ে আসতে হবে বাংলা ভাষার মাধ্যমে, জ্ঞানকে নিয়ে আসতে হবে বাংলা ভাষার কাছে। কিন্তু জ্ঞানের চর্চাই বিঘ্নিত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই এ রকম।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি আপনি কীভাবে দেখছেন?
রোহিঙ্গা ইস্যু একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। মিয়ানমারের সরকার যেটা করছে, সেটা তো সরাসরি গণহত্যা। আমরা বাংলাদেশীরা ভুক্তভোগী হচ্ছি। কারণ তারা যাবে কোথায়? রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার দরকার ছিল। বাংলাদেশ সরকারের মিয়ানমারের সরকারকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা দরকার ছিল। এর সমাধান দ্বিপক্ষীয়ভাবে হবে না। এর একটি আন্তর্জাতিক সমাধান দরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারল না। বাংলাদেশের কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি এ রকম নয় যে বাংলাদেশের একটি দুর্দশা বা সমস্যা হচ্ছে, আর তা নিয়ে বিশ্বের কোনো আগ্রহ তৈরি হবে। অন্য দেশে হলে কিন্তু ঠিকই আগ্রহ হতো। অন্য দেশে এ রকম একটি ঘটনা ঘটলে তারা হইচই লাগিয়ে দিত, তারা সারা বিশ্বের মধ্যে একটি উদ্বেগ সৃষ্টি করত, মিডিয়ায় এগুলো বারবার চলে আসত এবং বিশ্বজগৎ দেখত এখানে একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে। এ রকম যে একটি ঘটনা ঘটছে এবং এর যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে, বিশ্ব তা জানেই না। কারণ আমরা এটা তুলে ধরতে পারলাম না। প্রচারমাধ্যমও দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এটাকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা উচিত ছিল। বিদেশীরা এসে বরং এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেয়, তারা বরং তুলে ধরে। এখানে ধর্মীয় কোনো ব্যাপার নেই। পাকিস্তানিরা যেমন আমাদের বাঙালিদের হত্যা করেছিল, সেভাবেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে।
বাড়তে থাকা বৈষম্য বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে এর সমাধান মিলবে?
সামাজিক বিপ্লব ছাড়া সমাধান নেই। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ভেতর প্রতিশ্রুতি ছিল একটি সামাজিক বিপ্লব হবে। সামাজিক বিপ্লব হবে মানে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু সে সামাজিক বিপ্লব এখানে ঘটেনি। এখানে পুঁজিবাদের বিকাশের ধারাই অব্যাহত রয়েছে। পুঁজিবাদের যে করুণ পরিণতি, সেটাই এখন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে এবং বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের মানুষের যে সম্পদ, সে সম্পদের সঠিক বিতরণ হচ্ছে না। আজকের সারা বিশ্বের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় যাওয়া। ব্যক্তিমালিকানা দিয়ে বিশ্বের সমস্যার সমাধান হবে না। বর্তমান সময়টি একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিকাল। গোটা বিশ্বকে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সরে গিয়ে সামাজিক মালিকানায় যেতে হবে। প্রতিদিন সে প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে তাই প্রয়োজন সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলা। সংগ্রামটা আন্তর্জাতিক, এটা ঘটবে সব দেশেই। ঘটতেই হবে, নইলে এ পৃথিবী মনুষ্য বসবাসের উপযোগী থাকবে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক
সৌজন্যে: বণিক বার্তা