শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে আইসিটি ব্যবহারের অন্তরায় - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে আইসিটি ব্যবহারের অন্তরায়

মো. দ্বীন ইসলাম হাওলাদার |

যে দেশ যত শিক্ষিত,  সে দেশ তত উন্নত। শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন নবীকূল শিরোমনি হযরত মুহাম্মদ (স.)। বর্তমান বিশ্ব শিক্ষার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষার মানোন্নয়নে অনেক মহা প্রকল্প গ্রহণ করে চলছে। 

তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারও সমগ্র বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এবং সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রযুক্তি নির্ভর করার চেষ্টা চালাচ্ছে (বিশেষ করে মাধ্যমিক শাখা)। এ লক্ষ্যে শিক্ষকদের  আইসিটি প্রশিক্ষণসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ, প্রজেক্টরসহ কিছু কিছু যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। তবে আমাদের শিক্ষাবিদ ও সরকারের উচ্চ মহলের হীনমন্যতায় শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার ৯০ শতাংশেরও বেশি পিছিয়ে রয়েছে।

 মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে কম্পিউটারে কনটেন্ট তৈরি করতে হয়।  বর্তমানে নেট থেকে লোড দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এর পেছনে শিক্ষককে অনেক সময় ও শ্রম দিতে হয়, যা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার/ল্যাপটপে সম্ভব নয়। সরকার দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে একটি করে ল্যাপটপ (কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ল্যাব) দিয়েছে। তবে তা খুবই নিম্ন মানের হওয়ায় প্রায় সব গুলোই অচল। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে ল্যাপটপ কিনেছে। তবে অনেক মাদরাসায় শিক্ষকদের টাকায় শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, রেজিষ্ট্রেশন, ফরম পূরণসহ নানা কাজ পরিচালিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের প্রায় ৯০শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষিত হয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। সেখানে স্নাতক পাস একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন ১২,০০০ টাকা, বি.এড/ টাইম স্কেল সহ ১৬,৫০০ টাকা। বর্তমান বাজারে বাসা ভাড়া,  ছেলে/মেয়েদের শিক্ষা ব্যয় ও পারিবারিক ভরন-পোষণের জন্য তাকে ক্লাস শেষে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়তি আয়ের জন্য কঠিনভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়। 

সকাল ৯টা-৯:৩০টা থেকে বিকেল ৪টা-৪.৩০টা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে অবস্থান, এরপরে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যুদ্ধ। তারপর কীভাবে একজন শিক্ষক ল্যাপটপ কিনবেন বা তার পেছনে সময় দেবেন? আমাদের দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষকদের ল্যাপটপ কেনার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পাঠানোর জন্য তাদের স্মার্ট ফোন থাকা আবশ্যক। কিন্তু তা নেই অধিকাংশ শিক্ষকের। আর যতোদিন শিক্ষকদের পরিবারের ভরণ পোষণের বিষয়ে ভাবতে হবে অর্থাৎ সরকার তাদের  যুগোপযোগী সম্মানী না দেবে, ততদিনে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। 

একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, আরাকান রাজসভার কবি ছিলেন মহাকবি আলাওল। রাজদরবার থেকে মোটা অংকের সম্মানী দেয়া হতো তাকে পরিবারের ভরণপোষণের কোন চিন্তা করতে হতো না। তিনি শুধু কবিতা রচনা করে তা আবৃতি করে চল্লেন। পরবর্তীতে তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হলে তাকে রাজদরবার থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তার সম্মানী বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে মহাকবি আলাওলকে পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং তাঁর কবিতা রচনা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে, তিনি আবার রাজসভায় যোগদান করেন এবং কবিতা রচনা শুরু করেন।

তিনি যতোদিন পরিবারের ভরনপোষণের যুদ্ধে মগ্ন ছিলেন, ততো দিনে একটি বর্ণও রচনা করতে পারেননি। আমাদের দেশের শিক্ষকরা ১২,০০০ টাকা থেকে ১৬,০০০ টাকা বেতন পেয়ে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য গভীর রাত পর্যন্ত অন্য কাজ করবে। আর সরকার তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করবে। তা কী করে সম্ভব! পেটে না দিলে কীভাবে পিঠে সয় !

 সচিবদের মোবাইল কেনার বরাদ্দ ৭৫,০০০  টাকা, গাড়ির বরাদ্ধ আলাদা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিনাসূদে/স্বল্প সূদে হাউজিং লোন ও সরকারি হাউজিং এ প্লট বরাদ্ধ সাথে উৎকোচ বাণিজ্য ও সরকারি সম্পদ লুট তো থাকছেই। আর বেসরকারি অর্থাৎ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য থাকছে সরকারের চাহিদা পূর্ণ করতে না পারলে এমপিও হারানোর হুমকি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অধিকাংশ বড় বড় ভবন শিক্ষকদের, আর বঙ্গবন্ধুর সোনার স্বাধীন দেশে জরাজীর্ণ বাড়িগুলোর মালিক শিক্ষকরা। বাংলা সিনেমায়ও মেয়ের বাবার ভূমিকা থাকে সামান্য বেতনের স্কুল মাস্টার। শিক্ষা খাতে অনেক বরাদ্দ। তবে তা ভবন নির্মাণ, আসবাব ক্রয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে।

কিন্তু শিক্ষকদের বেতন ভাতা বা অন্যান্য সুবিধা প্রদানের জন্য নয়। মাননীয় অর্থমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে বলেন “অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে শিক্ষার মান  বাড়বে।” নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি বা শিক্ষকদের মান সম্মত তন-ভাতার দরকার নেই। অথচ তিনি এতটুকু উপলব্ধি করতে ব্যর্থ যে, কম্পিউটার কিছুই পারে না যোগ্য পরিচালক ছাড়া আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শিক্ষক না থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থাই বিকল। 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জেলখানার কয়েদিদের মতো সকাল ৯টা-৯: ৩০টা থেকে বিকেল ৪টা-৪.৩০টা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে থাকবে, ক্লাস শেষে শিক্ষকরা পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য গভীর রাত পর্যন্ত বাড়তি আয়ের জন্য যুদ্ধ করবে  (যা বিশ্বের কোথাও নেই)। শিক্ষকদের “শিক্ষা ব্যবস্থা” কার্যকর করার জন্য স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সময়টুকু দেয়া হয় না। তদুপরি নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক যুগ যুগ ধরে বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে যাচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের ওপরে রয়েছে বইয়ের খড়্গ। শিক্ষাবিদরা যেমন মানসম্মত শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি সরকারও শিক্ষকদের মানসম্মত সম্মানী না দিয়ে শিক্ষার মনোন্নয়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। মোট কথা হলো সরকার যতোদিনে শিক্ষকদের মানসম্মত সম্মানীসহ সার্বিক সুবিধা প্রদান না করবে, ততো দিনে দেশে বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে না। 

লেখক : প্রভাষক, দুমকি ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা, দুমকি, পটুয়াখালী।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

 

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007612943649292