শিক্ষার সংকট মোচনে চাই শক্ত ভিত্তি - Dainikshiksha

শিক্ষার সংকট মোচনে চাই শক্ত ভিত্তি

মো. মইনুল ইসলাম |

বলার অপেক্ষা রাখে না যে শিক্ষাই উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিক্ষিত মানুষই উন্নয়নের মূল কারিগর। শিক্ষার শুরু প্রাথমিকে। তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকার জাতীয়করণ করেছে। ফলে এর শিক্ষা এবং শিক্ষকের সামগ্রিক দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এখানেও বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। শিক্ষক স্বল্পতা এ স্তরে একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকের অভাবের কথা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। প্রধান শিক্ষকহীন বিদ্যালয়ে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকের দ্বারা প্রশাসন ও শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানের মতো দুটো কাজ যে দুরূহ হয়ে পড়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তদুপরি শিক্ষাদান ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষাবহির্ভূত কিছু কাজ যথা ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং ইপিআই টিকাদানে সহায়তা প্রদানের মতো কাজ করতে হয়। ফলে শিক্ষাদানের মতো মূল কাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্লাসরুমের স্বল্পতা এবং কোন কোন বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণতার সমস্যাও কম নয়। স্থানীয় কিছু শিক্ষকের গ্রাম্য রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা এবং কাজে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। যথাযথভাবে শিক্ষাদান হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের অসচেতনতাও সমস্যার একটি কারণ।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলি বাণিজ্য ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। চর ও হাওর অঞ্চলে যেমন আছে বিদ্যালয়ের অভাব, তেমনি আছে শিক্ষকদের অপ্রতুলতা। কচিকাঁচাদের শিক্ষাদানের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবের কথাও উল্লেখ করা দরকার। তাই এর গুণগত মান নিয়েও কিছু প্রশ্ন আছে। যার একটি প্রকাশ দেখা যায় শহরাঞ্চলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের এ সমস্ত বিদ্যালয়কে এড়িয়ে চলার মধ্যে। সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে তাদের সন্তানদের দূরে রাখার মানসিকতাও এখানে কাজ করতে পারে। এসব সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে অনেকটা সন্তুষ্টি প্রকাশ করা যায়।

প্রাথমিকের পরবর্তী পর্যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে মাধ্যমিক। প্রাথমিকে ভাষাজ্ঞান ও সংখ্যাজ্ঞানের স্ফুরণ ঘটে। আর মাধ্যমিকে তার বিকাশ ঘটতে থাকে। এ বছর মাধ্যমিকে পাসের হার ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। অঙ্ক এবং ইংরেজিতে খারাপ করার কারণেই এই ফল বিপর্যয়। এটা দেশের শিক্ষিত-সচেতন মানুষ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খুবই জানা যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা মাধ্যমিক পর্যায়ে। শিক্ষা ব্যবস্থাটি তলার পর তলায় সাজানো একটি ইমারত বা অট্টালিকার মরেতা। যদি নিচের তলাগুলো তথাভিত্তি দুর্বল হয়, তাহলে উপরের তলাগুলোও দুর্বল হতে বাধ্য। আমাদের উচ্চ শিক্ষার দুর্বলতারও বড় কারণ হলো মাধ্যমিক তথা হাইস্কুল শিক্ষার দুর্র্বলতা।

আগেই বলা হয়েছে, শিক্ষার মূল কারিগর হলো শিক্ষক। মাধ্যমিক শিক্ষার বেহাল অবস্থার বড় কারণ হলো পর্যাপ্ত সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। তার মধ্যে অঙ্ক এবং ইংরেজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষকের ভয়ানক অপ্রতুলতা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। গ্রামাঞ্চলে এ দুটো বিষয়ে শিক্ষক নেই বললেই চলে। বিষয় দুটির গ্র্যাজুয়েট বা স্নাতকরা সাধারণত মেধাবী থাক। তাই তারা সামাজিকভাবে ‘গরিবের চাকরি’ বলে অভিহিত শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না। দ্বিতীয়ত টিউশনির মাধ্যমে বাড়তি আয়ের সুযোগও গ্রামাঞ্চলে নেই। অথচ দেশের শতকরা প্রায় ৮০ জন গ্রামাঞ্চলেই বাস করে। শহরের বেসরকারি স্কুলগুলোতেও এ দুটো বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের অভাব আছে। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, মাধ্যমিকে শিক্ষার মান দুর্বল। এই দুর্বলতার ফলে পরবর্তী সব কয়টি ধাপ যথা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষাগুলো দুর্বলতার শিকার হয়।

মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়াতে সরকার সেকেপ (SEQEP) বা Secondary Education quality enhancement programme নামক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষার মান বাড়াতে হেকেপ (HEQEP) বা Higher Education quality enhancement নামক আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান না বাড়লে হেকেপ খুব বেশি একটা সফল হবে বিশ্বাস করার কারণ নেই। দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ইমারতের উপর তলাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নড়বড়ে হওয়া স্বাভাবিক। তারই একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে, দক্ষ জনশক্তির অভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার চলে যাওয়া। এটা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী যেমন স্বীকার করেছেন, তেমনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি এবং বাংলাদেশের বণিক সমিতির নেতৃবৃন্দও স্বীকার করেছেন। এর কারণ তাদের মতে, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব। একমাত্র গার্মেন্টস শিল্পেই দক্ষ জনশক্তির ২৪ শতাংশ বিদেশি। বিদেশিদের মধ্যে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার মানুষই বেশি। বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় অপারগতার কারণে এদের সঙ্গে আমাদের উচ্চ শিক্ষিতরা পেরে উঠছে না বা তাদের স্থান দখল করতে পারছে না। আমাদের গ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের ইংরেজি ভাষায় বেজায় দুর্বলতা দুঃখজনক, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা কালে সচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি।

মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবের বেশ কয়েকটি বড় কারণ আছে। এ রকম একটি কারণ হচ্ছে আর্থিক। এ সমস্ত স্কুলের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বেসরকারি এবং তাদের শিক্ষকদের বেতনভাতা খুবই কম। কর্মজীবনে উন্নতি (Career Development) নেই বললেই চলে। এমনকি স্বল্পসংখ্যক সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকদের কর্মজীবনে আয়-উন্নতি খুবই কম। সহকারী শিক্ষক হিসেবেই ১২-১৪ বছর চাকরি করার পরও পদোন্নতির সম্ভাবনা তেমন দেখা যায় না। তাছাড়া বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় চাকরির অন্যতম প্রধান দুটি আকর্ষণ হচ্ছে ক্ষমতা এবং অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ। শিক্ষকতার চাকরিতে এ দুটোরই অভাব। কিছু সংখ্যক শিক্ষক অবশ্য টিউশনি এবং কোচিং বাণিজ্য করে থাকে। তবে সব বিষয়ে এগুলো চলে না এবং গ্রামাঞ্চলের গরিব অভিভাবকদের সে টাকা দেয়ার সঙ্গতিও নেই বললেই চলে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার দুর্গতির আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে ম্যানেজিং কমিটি বা এমসি (মাধ্যমিকে) এবং গভর্নিংবডি বা জিবির (উচ্চ মাধ্যমিকে) দুর্নীতি। এই কমিটি এবং বডির মূল কাজ হলো প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ভৌত অবকাঠামো এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন। কিন্তু তা না করে, তারা নিজেদের পকেট ভারি করতেই বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এক সময় টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগদান নিয়মিত ব্যাপার ছিল। উপরোক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের এমসি/জিবি এর সভাপতি বহুদিন যাবত এলাকার সাংসদ বা এমপি সাহেবকেই থাকতে দেখা যেত। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক বিনিয়োগের বড় ধরনের অভিযোগ ছিল। সরকার পরে এটা টের পেয়ে এমপিদের এ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আমাদের একছাত্র কোন এক জেলার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ছিল। দুঃখের সঙ্গে সে আমাকে একদিন বলেছিল একজন এমপি সাহেবের কথা, যিনি তার নির্বাচনী এলাকার ৪টি স্কুলের সভাপতি হিসেবে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ৪-৫ লাখ এবং প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নিতেন।

তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় ১৫ মে (২০১৮) এর দৈনিক ইত্তেফাকের ‘ম্যানেজিং কমিটি-গভার্নিং বডির কাজ কী, আর করে কী’ ‘শীর্ষক প্রতিবেদনটি থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, আর্থিক ও প্রশাসন ব্যবস্থা তদারকি, লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করণের ধারণা থেকে ম্যানেজিং কমিটি ও গভার্নিং বডির সৃষ্টি। অথচ বেশির ভাগ কমিটিগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের পকেট ভারি করার উৎস হিসেবে দেখছে।’ প্রতিবেদক উপসংহারে বলেন, ‘নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য এবং প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে বেনামে টাকা খরচ করা ছাড়া তাদেরকে খুব একটা অন্য দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। অন্য দায়িত্ব গুলির প্রতি তাদের আগ্রহ নেই।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে অবৈধ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে যে সমস্ত শিক্ষক নিয়োগ পায় তারা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং নীতি-নৈতিকতায় খুবই দুর্বল। এ ধরনের শিক্ষক কতটা মানসম্পন্ন শিক্ষা দেবে তা সহজেই অনুমেয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে উপযুক্ত শিক্ষকের নিদারুণ অপ্রতুলতার কারণ উপরে আলোচিত সমস্যাগুলো থেকে স্পষ্টতই ফুটে উঠবে।

পরিশেষে বলতে হয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য সত্যিকার শিক্ষিত এবং দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য দরকার মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং শিক্ষক। শিক্ষার ভিত্তি হল প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা। এই ভিত্তি দুটিকে বিশেষ করে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করতে হবে। আর তার জন্য দরকার পর্যাপ্ত সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষক। এর জন্য আর্থিক এবং অনার্থিক প্রেষণার (Motivation) ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা বললেই শিক্ষকের মানসম্পন্ন জীবনযাপনের ব্যবস্থা হবে না। তার বাস্তব প্রয়োজনগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার কথা অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন। এ কাজটি দ্রুত করতে হবে। এর সঙ্গে শিক্ষকদেরকেও জবাদিহির আওতায় আনতে হবে। মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ তাদের কাজ দ্বারাই শিক্ষাকে বাস্তবে একটি মহান পেশা রূপে প্রমাণ করতে পারেন। মজবুত ভিত্তি ছাড়া শিক্ষার সংকট মোচন সম্ভব নয়।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042009353637695