শিক্ষার সেকাল ও একাল - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার সেকাল ও একাল

এন. জি. পাল |

প্রখ্যাত গায়ক (সম্ভবত) সনৎ কুমার সিংহের সেই বিখ্যাত গানটির প্রথম কয়েকটি চরণ হলো- 'এক একে এক, দুই একে দুই/ নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে/ নন্দীবাড়ির আটচালাতে, কুমোর ঠাকুর গড়ে..।' গানটিতে বর্ণিত দৃশ্যপট হচ্ছে, ছেলেরা সুর করে পণ্ডিতের কাছে নামতা পড়ছে। এদিকে আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে মণ্ডপে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। প্রতিমার গড়ন কতটুকু এগোচ্ছে, কোন প্রতিমার রঙ দেওয়ার কাজ চলছে বা কার চক্ষুদান হচ্ছে- এসব কল্পনা করে ছেলেরা নামতা পড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। গানটির অবতারণা করেছি অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন বাংলাভাষী অঞ্চলের শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর বিষয়ে আলোকপাত করতে।

ওই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ) এই ছিল স্কুল-পূর্ব ও শিশু শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের একটি রীতি। শিশুরা সুর করে নামতাসহ অন্যান্য পাঠ্য বিষয় পাঠ করত। তখন অনেক বিত্তশালী বা জমিদারদের অর্থানুকূল্যে তাদের বাড়ির আঙিনা বা অন্যত্র এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু ছিল। উল্লেখ্য, পণ্ডিতদের এসব টোল বা অনানুষ্ঠানিক পাঠশালায় সাধারণত হিন্দু ছাত্রছাত্রী পড়ত। আর মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা পড়ত মক্তবে। এই মক্তবে মৌলবি সাহেবরা সাধারণত আরবি শিখাতেন। এই টোল ও মক্তব ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতিমূলক স্কুল-পূর্ব শিক্ষা। এগুলোতে আসবাবপত্র ছিল খুব সাধারণ। শিক্ষার্থীদের বসার জন্য ছিল মাদুর বা পাটি আর লেখার জন্য মাটির শ্ন্নেট ও চক। শিক্ষকরা বসতেন কাঠের টুল বা চৌকিতে। 

ভারত বিভাগ-পূর্ব কাল থেকে শিশুদের স্কুল-পূর্ব শিক্ষার দুটি ধারা ছিল- সাধারণ শিক্ষা ও আরবি-উর্দু শিক্ষা। ওপরে যেমনটি বলা হয়েছে, পণ্ডিতদের টোল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালয়ে সাধারণত হিন্দু পরিবারের ছেলেমেয়েরা সাধারণ শিক্ষা অর্থাৎ বাংলা, অঙ্ক (মানে ধারাপাতে বর্ণিত বিষয়), ইংরেজি এগুলো পড়ত। অপরদিকে সাধারণ মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা মক্তবে আরবি, উর্দু ও কোরআন শরিফ পড়তে শিখত। তবে অনেক আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন মুসলিম পরিবার তাদের ছেলেমেয়েকে সাধারণ শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। সেটা মক্তবেই হোক বা অন্য কোনো পণ্ডিত বা মৌলবির তত্ত্বাবধানেই হোক। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ঘটে। মাধ্যমিক স্কুলের শেষ পাবলিক পরীক্ষার নাম ম্যাট্রিকের পরিবর্তে এসএসসি করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় এইচএসসি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২০০১ সালে প্রথম এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফল মূল্যায়নে 'গ্রেডিং' পদ্ধতি চালু করা হয়। আর এইচএসসি এবং আলিম পরীক্ষায় প্রথম 'গ্রেডিং' পদ্ধতি চালু করা হয় ২০০৩ সালে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সামনে চলতে হয়। এই পরিবর্তনের পাশাপাশি যদি পূর্বের শিক্ষার মান ধরে রাখা যেত, তাহলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠত না; বরং তা সোনায় সোহাগা হতো। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এর বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। এক. পূর্বপ্রস্তুতি ব্যতিরেকে নতুন পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি। আরেকটি কারণ, '৭২ সালে সব পরীক্ষার ক্ষেত্রে অটো প্রমোশন দেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মেধা পরীক্ষার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে পড়াশোনা না করতে পারার ক্ষতি অন্যভাবে পুষিয়ে নিলে ভালো হতো।

শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো, দেশের যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল-কলেজ খোলার অনুমতি দেওয়া। এটা সত্য যে, ছাত্রছাত্রী বৃদ্ধির তুলনায় আমাদের এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ততটা বাড়েনি। কারণ এদিকে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বেশি যত্নবান ছিল না। এটা ছিল তাদের এক বৈষম্যমূলক নীতি। তারা এ দেশের মানুষ শিক্ষিত হোক- চায়নি। চেয়েছে এ দেশের মাটি। কিন্তু যেভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল-কলেজ খোলার অনুমতি দেওয়া হলো, তাতে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি। 

পূর্বের শিক্ষানীতি, যা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও সাম্প্র্রদায়িক, তার পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর জাতির পিতার নির্দেশে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। সে কমিশন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। কিন্তু পঁচাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করলে তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষানীতি নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র হতে লাগল এবং পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি পুনর্বহাল করা হলো। দেশপ্রেমিক ও উদার মনোভাবাপন্ন শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন হতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার '৯৬তে এসে আবার শিক্ষানীতিকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করতে থাকে। স্কুল-কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ফিরিয়ে আনা হয়। সিলেবাসকে অসাম্প্রদায়িক করা হয়। স্কুলে পুরাতন পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রথম পরীক্ষা ২০১০ সালে প্রচলন করা হয়। নতুন পদ্ধতি চালুর পূর্বে যে অনুশীলন প্রয়োজন, তা করা হয়নি। শুধু জিপিএ ৫ পেলেই শিক্ষার মান বাড়ে না। মানসম্মত শিক্ষাদানই এখনকার মূল বিবেচ্য হওয়া উচিত। মফস্বলের স্কুল-কলেজের অবস্থা অতি শোচনীয়। শিক্ষকরা নিজেরাই সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না; তারা কীভাবে ছাত্রদের পড়াবেন? বিষয় ও সিলেবাসের ভারে ছাত্রছাত্রীরা ন্যুব্জ। ফলে এর সুযোগ নিচ্ছে কিছু অসাধু শিক্ষক। তারা তাদের কোচিং করতে বাধ্য করে।

এতে অভিভাবকরা নিতান্ত অসহায়। সম্প্রতি পাঠ্যসূচি নির্ধারণ নিয়ে আরেক ষড়যন্ত্র শুরু হলো। সরকার যেখানে পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে তৎপর, সেখানে কিছু ধর্মান্ধ ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সংশ্নিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পাঠ্যসূচি সাম্প্রদায়িকীকরণে সক্রিয় হয়ে উঠল। তা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে প্রচুর ভুল ও ইতিহাস বিকৃতি ঘটতে লাগল। পাঠ্যসূচিতে পূর্ব থেকেই অন্তর্ভুক্ত প্রথিতযশা ও উদার মনোভাবাপন্ন লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখা ঢোকানো হলো। শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন; সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো নয়। 

বিগত কয়েক বছর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে আরেক উপদ্রব দেখা যায়। তা হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস, যা পূর্বে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অভিযোগ আছে, এক শ্রেণির কোচিং সেন্টার, শিক্ষা প্রশাসন ও বিজি প্রেসের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা এর সঙ্গে জড়িত। এ সবকিছুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার মান যে কোন পর্যায়ে নামল, তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখলেই পরিস্কার বোঝা যায়। জিপিএ ৫ পেয়েও স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও বর্তমানে খুব নাজুক। পূর্বে অনার্স ও মাস্টার্সে বিশেষ করে কলা বিভাগে ছাত্রছাত্রীরা প্রথম শ্রেণি পেলেও তার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ৫২ জন ছাত্রছাত্রীর প্রথম শ্রেণি পাওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করল। এ তো গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও শোচনীয়। ১৯৯০-এর শেষভাগ থেকে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেওয়া শুরু হয় এবং অদ্যাবধি তা চলমান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সীমিত। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭ এবং অন্যান্য ১৮টি। প্রতি বছর কলেজগুলো থেকে যে সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এইচএসসি পাস করে বের হয়, তাদেরকে বিদ্যমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। ফলে তাদেরকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, যা সাধারণ কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েদের পক্ষে সম্ভব নয়। অনন্যোপায় হয়ে তাদেরকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়। বর্তমানে ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের অনুমতি নিয়ে কাজ করছে। তাদের জন্য পৃথক নীতিমালা রয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অন্যদের নিজস্ব কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। ভাড়া বাড়িতে এসব বিশ্ববিদ্যালয় চলে। তাতে সব ছাত্রছাত্রীর পড়ার ক্লাসেরই সংকুলান হয় না; আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ডের কথা বাদ দেওয়া গেল। মারাত্মক কথা হলো, অধিকাংশেরই অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নেই। তাদের গবেষণা করার কোনো উপযুক্ত পরিবেশ ও মানসম্মত লাইব্রেরি নেই।

শুধু পদ্ধতিগত পরিবর্তন বা উচ্চ পাসের হার শিক্ষার মান বাড়ায় না। এ জন্য প্রথমেই দরকার প্রকৃত জ্ঞান ও মানবিক গুণাবলির উদ্রেক করে এমন সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন শিক্ষার উপযোগী মানসম্মত পাঠ্যক্রম। শিক্ষার মাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন ভাষা হতে পারে; কিন্তু এর কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি বা দেশ নেই। তাই উচ্চ শিক্ষালয়কে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। তা ছাড়া শিক্ষার পরিবেশ ও নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে সক্ষম অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী প্রয়োজন, যাদের সময়ে সময়ে নতুন সিলেবাসের ওপর প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং এটি হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া।

লেখক: সাবেক অতিরিক্ত সচিব

 

সৌজন্যে: সমকাল

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048549175262451