উত্তরায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ২৯ জুলাই দেশ-বিদেশের নজর-কাড়া যে আন্দোলনের সূচনা করে, তা এখন সমাপ্তপ্রায় হলেও শেষ দিকে এতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আন্দোলনের সূচনাকারী শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ রাজপথ ছেড়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেলেও ৫ আগস্ট থেকে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রকাশ্য সংঘর্ষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলীয় রাজনৈতিক বিতর্ক ও অবস্থান মূল দাবিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দলীয় ছাত্র সংগঠনের অসঙ্গত হস্তক্ষেপের অভিযোগ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী নানা খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস দিয়ে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণ ও একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘটনা ঘটেছে।
উল্লেখ্য, ২৯ জুলাই উত্তরায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে আপনজনের বিয়োগ ব্যথা হিসেবে বিবেচনা করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে রাজপথে নেমে আসে। বাস, ট্টাক, প্রাইভেট ও সরকারি গাড়ির লাইসেন্স-ফিটনেস পরীক্ষা করতে শুরু করে। তার মধ্যেও গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের দ্রুত বের হওয়ার পথ সুগম করতে প্রয়াস চালায়। এ অবস্থা ৭ দিন ধরে চলে। এর মধ্যে ঢাকার আন্দোলন ক্রমেই বিভিন্ন জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের এ আন্দোলন মতপথ নির্বিশেষে সবার সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করে। আন্দোলনের তৃতীয় দিনে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের একজন নেতার অডিও কথোপকথন প্রকাশ পেলে প্রথমে তিনি তা অস্বীকার করেন। কিন্তু একদিন পর তারই দলের মহাসচিব তা মেনে নিয়ে বলেন, এতে কোনো অপরাধ হয়নি। এর ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে আপনগতিতে চলতে না দিয়ে সরকারবিরোধী দলটি সরকারকে কাবু করে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে আগ্রহী। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল ভিন্নধারার। দুই সহপাঠীর নির্মম হত্যাকাণ্ডে সহমর্মিতা প্রকাশ, ফুটপাতে থাকা অবস্থাতেও তাদের নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে গাড়ি চালকের অমার্জনীয় অদক্ষতা ও অবহেলার পুনরাবৃত্তি রোধ, পরিবহন ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কার্যকর প্রতিকার, স্কুল-কলেজে পড়ূয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বাস ও যানবাহনে অর্ধেক ভাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে গতিরোধক ব্যবস্থা চালু এবং দুই শিক্ষার্থীর ঘাতক বাসচালকের ফাঁসি দাবি ছিল এর মূল কথা।
শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ও আন্দোলনের স্বকীয়তা রক্ষায় কিছু মানুষের অবস্থান, ভূমিকা ও উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, চট্টগ্রামের মেয়র, নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, মিরপুরের সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. বরমান হোসেন। শেষোক্ত ব্যক্তি বাদে অন্যরা শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো রূপ বিভ্রান্তির শিকার না হয় এবং গুজবে বিশ্বাস না করে সে লক্ষ্যে তাদেরকে সুপরামর্শ দেন। আন্দোলনকারী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর যাতে কোনো জোর খাটানো না হয়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তাদের দাবি মেনে নেওয়ার অব্যাহত ঘোষণা শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ ও আস্থাশীল করে তোলে। এ সময় সড়ক নিরাপত্তা রক্ষায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কের শিবগঞ্জের পাইলিং মোড়ে লাইন্সেসবিহীন ও হেলপার দিয়ে বেপরোয়া ট্রাক চালানোর অপরাধে দু'জনকে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. বরমান হোসেন। এ ছাড়াও মহাসড়কে চলমান অন্য গাড়িগুলোর লাইন্সেস, ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। এ সময় আটককৃত দু'জন তাদের অপরাধ স্বীকার করলে কারাদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়।
শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলন স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে শুরু হয় তাদের স্বল্প সময়ের কার্যক্রমে অনভিজ্ঞতা দিয়ে, সহপাঠীদের প্রতি মানবিক, আবেগপ্রসূত অবস্থান থেকে। তা সত্ত্বেও তারা পরিবহন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও সীমাহীন দুর্নীতি, গাড়ি চালকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের অমার্জনীয় অদক্ষতা ও বেপরোয়া মনোভাব, যানবাহন নিবন্ধন ও ফিটনেস তদারককারী কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশের মধ্যে আইন না মানার মানসিকতা, সর্বোপরি ব্যাপক নাগরিক অসচেতনতার বিষয়গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। তবে গাড়ি চালকদের প্রতি গাড়ি মালিকদের একটা বড় অংশের প্রভুসুলভ, অমানবিক আচরণের অভিযোগ ও আর্থিক লাভালাভে অতি প্রাধান্যের প্রসঙ্গ সেভাবে স্পষ্ট হয়নি। অন্যদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষকরা তাদের কাছে সংকট নিরসনে সম্ভাব্যতা ও সীমাবদ্ধতার দিকগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেননি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কতদূর যেতে পারে ও যাওয়া সঙ্গত- তার কোনো যৌক্তিক পরামর্শ তাদের কাছ থেকে আসেনি। তাদের আন্দোলনের কারণে জনদুর্ভোগের, বিশেষ করে যাত্রীসাধারণের চলাচল ও চিকিৎসাপ্রার্থী নারী-পুরুষের অবর্ণনীয় কষ্টের বিষয়টি ছাত্রছাত্রীরা লাঘবের প্রয়াস নিলেও তা যে যথেষ্ট ছিল না, তাও তাদের কাছে তুলে ধরা হয়নি। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার ধারাবাহিকতায় সোমবার মন্ত্রিসভা জেল, জরিমানা ও ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০১৮ সালের যানবাহন চলাচল আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। এর পরে শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা মহানগরের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কলেজ অধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠক করে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। এ সময় প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষরা জানান যে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবাই শিক্ষার্থী কিনা, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর আগের মতো হেডমাস্টার, অধ্যক্ষদের কথায় চলে না। যদিও জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন, নেতৃত্ব দেওয়ার কথা প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের। আর প্রধান সহযোগী থাকার কথা শিক্ষার্থীর মা-বাবা, অভিভাবকদের। বহিরাগত অন্যরা যেমন জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম সীমিত থাকবে উপদেশ ও পরামর্শদানের মধ্যে। বলাই বাহুল্য, রাজপথের আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে বিলম্বের জন্য বিশেষভাবে দায়ী যথোচিত, সময়ানুগ উদ্যোগ গ্রহণে শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষদের উপরোক্ত অক্ষমতা। এসব অক্ষম মানুষের সক্ষমতা নিশ্চিতের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক: জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য; শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা
সৌজন্যে: সমকাল