গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ সালের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ৯ জন; ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজনসহ সারাদেশে ১১ জন এবং ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনসহ সারাদেশে আত্মহত্যা করেছিল ৯ জন।
আত্মহত্যার এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. তাইফুর রহমান প্রতীক। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের এই মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেন। পরিবারের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন কোর্সে নাম্বার কম দেওয়ায় ফল খারাপ হয় প্রতীকের এবং ভেঙে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। এটা মেনে নিতে না পেরেই আত্মহত্যা করেন তিনি। এ যেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবাশীষ মণ্ডলের আত্মহত্যার ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সব যোগ্যতা পূরণ করেও কেবল ঘুষ না দেওয়ায় শিক্ষক হতে না পেরে ২০১৮-এর মে মাসে আত্মহত্যা করেছিলেন এই শিক্ষার্থী।
একই বছরের সেপ্টেম্বরে গ্র্যাজুয়েশন শেষের দুই বছর পরও চাকরি না পাওয়ায় আত্মহত্যা করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈকত রন্জন মণ্ডল। এছাড়াও ২০১৮ সালে ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তরুণ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যার কারণ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত; কিন্তু কেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে অসীম সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েও একজন শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে যাচ্ছে? এর সমাধান কী? একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াটাকেই জীবনের সবকিছু ভাবছেন! তার এই চিন্তা-ভাবনার পেছনে কি আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী নয়?
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় জ্ঞানার্জন ও গবেষণার জন্য, সেখানে আমাদের দেশে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় একটা ভালো চাকরির জন্য। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, চাইলেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়! আমরা যদি একটি গবেষণানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পারি, তরুণদের মাঝে যদি ভালো প্রতিষ্ঠানের কর্মী হওয়ার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ তৈরি করতে পারি, তবে হয়তো কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীদের হতাশা দূর করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মানোন্নয়ন করতে হবে। এতে কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষকরা সহজেই বুঝতে পারবেন এবং হতাশা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। কোনো শিক্ষক যেন শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গের কারণ না হয়, শিক্ষকরা যেন হয় শিক্ষার্থীদের সব থেকে বড় আশ্রয়, স্বপ্ন গড়ার কারিগর। শিক্ষকদেরই শিক্ষার্থীদের অনুধাবন করাতে হবে যে, জীবন সম্ভাবনাময়, স্বপ্নভঙ্গ মানেই জীবনের শেষ নয় বরং তার সামনে রয়েছে হাজারো সম্ভাবনা। সর্বোপরি আমাদের একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জীবনের জন্য স্বপ্ন, স্বপ্নের জন্য জীবন নয়।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌজন্যে: সমকাল