শিক্ষার্থীরা সারা বছর লেখাপড়া করে একটা ন্যায্য ফলাফলের প্রত্যাশায়। যদি তারা ন্যায্য ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে তারা সমাজ ও দেশের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়। আমি অনেক শিক্ষার্থীকে চিনি, যাদের মেধার সাথে ফলাফল যায় না। এটা বহুল শ্রুত ও প্রায় সর্বস্বীকৃত ব্যাপার যে অনেক শিক্ষক পাবলিক পরীক্ষার খাতা নিজে মূল্যায়ন না করে অন্যের দ্বারা মূল্যায়ন করিয়ে থাকেন। আবার কোন শিক্ষক নিজের অযোগ্যতার কারণে বা সময়াভাবে সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করেন না বা করতে পারেন না। কিছুদিন পূর্বেও শিক্ষকদের মধ্যে ধারণা ছিল, খাতায় লেখা থাকলে নম্বর দিতে হবে, নম্বর কম দেওয়া যাবে না, ফেল করানো যাবে না ইত্যাদি।
এখন হয়েছে তার উল্টো। শিক্ষকেরা এখন মানসিকভাবে নম্বর বেশি না দিতে প্রস্তুত। বেশি নম্বর দিলে তাঁদের জবাবদিহি করতে হয় কিনা, এই শঙ্কায় তাঁরা শঙ্কিত। সরকার হার্ড লাইনে গিয়েছেন এই মেসেজটা তাঁরা মাথায় ধারণ করে রেখেছেন। এই কঠিন অবস্থার মধ্যে কোন্ শিক্ষার্থীর জীবন কখন যে নষ্ট হয়ে যায় তার ঠিক নেই। আমরা মনে করি, খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হোক। যার যা পাওনা তা সে তা বুঝে পাক। কিন্তু ভুলভাবে খাতা মূল্যায়িত হওয়ার কারণে যদি মেধাবীদের জীবন ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার দায়িত্ব কে নিবে? নীরব বিষ দিয়ে কাউকে হত্যা করা আর এভাবে মেধাবীদের জীবন ধ্বংস করা একই কথা। মানুন আর না-ই মানুন মেধাবীদের জীবন ধ্বংসের এ মহোৎসব চলছে এবং চলছে। এর প্রতিকার কী? এর প্রতিকার হিসেবে আমরা ‘শিক্ষাবোর্ড বরাবর খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করা ও সঠিকভাবে পুনর্মূল্যায়িত হওয়া’কে ধরে নিতে পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবক সমাজে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত যে, পাবলিক পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু নম্বর গণনায় ও নম্বরশিটে নম্বর ওঠানোতে কোন ভুল ভ্রান্তি আছে কিনা তা দেখা হয়। যদি ঘটনা এটাই হয়, তাহলে এটা একটা রাষ্ট্রীয় অবিচার এবং অধিকার প্রদানের নামে এটা একটা প্রহসন। শিক্ষকদের মধ্যে একটা ধারণা (perception) কাজ করে যে, লেখা সুন্দর না হলে নম্বর কম দিতে হবে। কোন শিক্ষার্থীকে লেখা খারাপ হওয়ার জন্যে যদি ০৩ (তিন) নম্বরের মধ্যে ২ নম্বর দেওয়া হয় তাহলে সে শতকরা ৩৩ ভাগ নম্বর থেকে বঞ্চিত হবে। তথ্যবহুল, যৌক্তিক ও নির্ভুল উত্তর সমেত কোন খাতাতে শুধু এ কারণে নম্বর কম দেওয়া হয় যে, খাতাটির লেখা অসুন্দর।
বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মাক্সের লেখা কিন্তু ভয়ানক অসুন্দর ছিল। তার জন্ম যদি এখনকার এই বাংলাদেশে হতো তাহলে তিনি খারাপ ফলাফলের ভারে নুয়ে পড়তেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাও রাখতেন না। একইভাবে যদি বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্ম এখনকার এ দেশে হতো, তাহলে তিনি বাংলা বা ইংরেজিতে C বা D গ্রেডের ঊর্ধ্বে পেতেন না। ফলাফল স্বরূপ তিনিও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা রাখতেন না। Extra ordinary মেধাবীরা নিজেকে বিশেষ বিষয়ে নিবিষ্ট করেন বিধায় তারা সর্ববিষয়ে সমান পারঙ্গমতা প্রদর্শন করতে পারেন না। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশের ভর্তি পদ্ধতি Extra ordinary মেধাবীদের মেধা বিকাশের জন্য বিরাট অন্তরায় স্বরূপ।
ফলাফল নানা কারণে খারাপ হতে পারে। সত্যিকার মেধাবীরা ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেলে তারা তাদের মেধার প্রকাশ ঘটাবেই ঘটাবে। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ উদার ও অবারিত হলে (পাশ করা সকল ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকবে।) শিক্ষার্থীরা ফলাফলভিত্তিক (Result oriented) পড়াশোনা করবে না, তারা জ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনা করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। অর্থাৎ তারা result-এর পিছু ছুটবে না, তারা ছুটবে জ্ঞানের পিছে। তারা সার্টিফিকেটের চেয়ে নিজের যোগ্যতাকে শ্রেষ্ঠতর মনে করবে। তারা মনে করবে, যে result তাদের কোন কাজে দেবে না, তা অর্জনের জন্য তারা নকল করবে না, দেখাদেখি করবে না, প্রশ্নফাঁসের পেছনে দৌড়াবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাবে এবং ভুলভাবে তার মেধা মূল্যায়িত হওয়ার জন্য তার কোন খেদ থাকবে না।
লেখক : উপাধ্যক্ষ, প্রশান্তি স্কুল এন্ড কলেজ, বিসিক শিল্পনগরী, মধুপুর রোড, জামালপুর।