জানা যায়, রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের ইংরেজি ভার্সনের একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি প্রথম পত্রে ৬০ পেয়েছে। বাকি সব কটিতে সে জিপিএ ৫ পেয়েছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রেও সে পেয়েছে ৯২। ওই বিদ্যালয়ের ইংরেজি ভার্সনের ১৬ জন শিক্ষার্থীই ইংরেজি প্রথম পত্রে কম নম্বর পেয়েছে; অথচ অন্য সব বিষয়ে তারা এ প্লাস পেয়েছে। ইংরেজি প্রথম পত্রে তারা ৫৫ থেকে ৬৪-এর মধ্যে নম্বর পেয়েছে। একই ঘটনা বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটেছে। খাতা মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। এর কারণ হচ্ছে, ইংরেজি ভার্সনে যাঁরা পড়াচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ইংরেজি ভার্সনে পড়ানোর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। অনেক বিদ্যালয়ে বাংলা ভার্সনের শিক্ষকরাও ইংরেজি ভার্সনের ক্লাস নেন। এসব শিক্ষক খাতাও মূল্যায়ন করছেন। বাংলা ভার্সনের প্রশ্নই ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। রোববার (১৬ জুন) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মাছুম বিল্লাহ।
এবার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার পর সারা দেশে তিন লাখ ৬৯ হাজার খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জমা হয়।
শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ অনেকেই মনে করে, খাতা পুনর্মূল্যায়ন মানে পুনরায় খাতা দেখা। মূলত হওয়াও উচিত তাই। কিন্তু হচ্ছে এর পুরো উল্টোটা। ফল নিরীক্ষণে মাত্র চারটি বিষয় দেখা হয়। এক. সব প্রশ্নের উত্তরে নম্বর সঠিকভাবে বসানো হয়েছে কি না; দুই. প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিকভাবে করা হয়েছে কি না; তিন. প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটে তোলা হয়েছে কি না এবং নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কি না। আসল বিষয়টি, অর্থাৎ উত্তরপত্র পুনরায় দেখা এবং মূল্যায়ন করা হয় না। একজন পরীক্ষক খাতা দেখার পর তাঁর নম্বর প্রদান করা ঠিক আছে কি না, তা দেখা হয় না। আশ্চর্যান্বিত হওয়ার বিষয়! বোর্ড ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু নম্বর যোগ-বিয়োগের ভুলেই একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়ে থাকে। এ অবস্থায় পুনরায় খাতা দেখলে আবেদনকারীদের বেশির ভাগেরই ফল পরিবর্তন হবে, পরীক্ষকদেরও আরো কয়েক গুণ ভুল ধরা পড়বে।
নীতিমালা অনুযায়ী প্রধান পরীক্ষক হওয়ার জন্য ১০ বছর এবং পরীক্ষক হওয়ার জন্য পাঁচ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এসব নিয়ম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয় না। প্রতিষ্ঠানপ্রধান সম্মতি দিলেই পরীক্ষক হয়ে যাচ্ছেন সব ধরনের শিক্ষক। জুনিয়র সেকশনের শিক্ষক পরীক্ষক হচ্ছেন সিনিয়র সেকশনের, কলেজের শিক্ষকও স্কুলের খাতা দেখছেন। আমি দেখেছি কলেজের শিক্ষক মাদরাসার খাতাও পরীক্ষণ করছেন। কোনো একজন শিক্ষক যদি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও একটি বিষয় পড়ান, তিনি ওই বিষয়ের পরীক্ষক হয়ে যান। এভাবে এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয়ের পরীক্ষক হচ্ছেন। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে তো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। এ সুযোগ আরো কাজে লাগানো হচ্ছে। অনেকে তদবির করে পরীক্ষক হন। প্রধান পরীক্ষকদের শতকরা ১০টি খাতা পুনর্মূল্যায়ন করার কথা; কিন্তু এই কাজ অনেকেই করেন না, খাতায় সই করেই তাঁরা খালাস।
বোর্ডের খাতা পরীক্ষণে কিছু পরিবর্তন আনতেই হবে। প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপও কমে যাবে, শিক্ষার্থীরা বিষয়ের গভীরে যেতে পারবে এবং এ ধারাবাহিকের ফল বোর্ডেও প্রেরণ করতে হবে, যাতে একজন শিক্ষার্থীর হঠাৎ কোনো পরিবর্তন বা বিপর্যয় সহজেই ধরা পড়ে। এটি করা হলে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাসও করবে এবং এই মূল্যায়ন গুরুত্ব পাবে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। সেটি হচ্ছে বোর্ডের খাতা পরীক্ষণ কোনোভাবেই একজন শিক্ষকের দ্বারা করানো যাবে না। তিনজন হলে ভালো হয়, সম্ভব না হলে অন্তত দুজন পরীক্ষক একটি উত্তরপত্র পৃথকভাবে মূল্যায়ন করবেন। কারোর নম্বর কেউ জানবেন না। এটি করা হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর খাতা পুনর্মূল্যায়নের দরখাস্ত জমা পড়ে, অথচ তাদের খাতাও পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না, সেই অনৈতিক দিকটিকে এড়ানো যাবে এবং লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে এভাবে আর ঠকাতে হবে না। বোর্ড পরীক্ষার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে, আস্থা বেড়ে যাবে। পরীক্ষার ফল নিয়ে আর খুব একটা প্রশ্ন থাকবে না, যেটা এখন আছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় মনোযোগ দেবে। তারা শুধু পরীক্ষার্থী হবে না, হবে প্রকৃত শিক্ষার্থী।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক