শিক্ষায় অর্থায়ন: গৌরী সেনের সন্ধানে - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষায় অর্থায়ন: গৌরী সেনের সন্ধানে

চৌধুরী মুফাদ আহমদ |

বিশ্বে এখন তথাকথিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ শুরু হয়েছে। এই বিপ্লবের ভিত্তি জ্ঞান। উন্নত থেকে উন্নততর জ্ঞান, নতুন উদ্ভাবনী জ্ঞান। নতুন নতুন উদ্ভাবন বদলে দিচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির পুরোনো সব হিসাব-নিকাশ। কিন্তু এই জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম যে বিশাল আলোর প্রদীপ জ্বালছে, তার নিচে এক বিশ্রী, অস্বস্তিকর অন্ধকার। বৈষম্যে আকীর্ণ এই বিশ্বে এখনো ২৬ কোটির বেশি শিশু-কিশোর স্কুলে যায় না। যারা যাচ্ছে, তাদের অনেকেই স্কুলে গিয়ে যা শেখার তা শিখছে না। এখন যেমন চলছে, তেমন করে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে নিম্ন আয়ের দেশে ১০ শিশুর মধ্যে মাত্র ১ জন মাধ্যমিক পর্যায়ের মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে। আর নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ ধরে হিসাব করলে এই সংখ্যা ১০-এ মাত্র ৪ জন! 

বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের যুগ শুরু হওয়ার আগে এক দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে অন্য দেশের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এখন আছে। এখন বাংলাদেশের গার্মেন্টসশ্রমিকদের স্বাস্থ্য, আফ্রিকার খনিশ্রমিকের গড় আয়ু কিংবা ভারত বা ব্রাজিলের মাধ্যমিক শিক্ষার মান বিশ্ব অর্থনীতিতে বিলক্ষণ ‘ম্যাটার’ করে।

এ কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার কিছু যুগান্তকারী ও টেকসই উন্নয়ন ঘটানোর এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দুনিয়ার তাবৎ দেশ এই পরিকল্পনায় শামিল। ইউনেসকোর পৌরোহিত্যে একদল শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ বহু খেটেখুটে এ জন্য বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট টার্গেট বা লক্ষ্য স্থির করেছেন। সব বালক-বালিকা যাতে বিনা অর্থ ব্যয়ে ও বৈষম্যের শিকার না হয়ে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে, তা নিশ্চিত করা। সব শিশুর জন্য প্রাক-শৈশব যত্ন ও কমপক্ষে এক বছরের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। সব নারী-পুরুষের জন্য স্বল্পমূল্যে মানসম্মত কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের অবসান ঘটানো। সুবিধাবঞ্চিত, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাভুক্ত সব মানুষের জন্য শিক্ষার ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি নানা অতি জরুরি কিন্তু উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষা এসব লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশসহ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলো এই লক্ষ্যগুলোকে ধ্রুবতারা স্থির করে ‘বদর বদর’ বলে তরি ভাসিয়ে দিচ্ছে।

দুই. 
ভারতের স্বাধীনতার পর নেহরু সরকারে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। একদিন শিক্ষার নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনার সময় পার্লামেন্টে তিনি প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পড়েন। একজন সদস্য জিজ্ঞেস করেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর মাথার ভেতর কি ফাঁকা? ঘিলুটিলু কিছু নেই নাকি?’

জবাব দিতে দাঁড়িয়ে মাওলানা আযাদ নিজের মাথায় টোকা মেরে বলেন, ‘এখানে যা থাকার, তা ঠিকই আছে।’ তারপর পকেটে হাত দিয়ে বলেন ‘কিন্তু এখানে যে ফাঁকা...।’

হ্যাঁ, টাকারই সমস্যা! শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই শিক্ষা এক দুয়োরানি। তার জন্য টাকা নেই।

২০৩০ সালের মধ্যে দুনিয়াজুড়ে শিক্ষার একটি জুতসই ও টেকসই উন্নতি করতে অর্থ প্রধান সমস্যা। তাই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দল টাকার হিসাব কষেছে। এই হিসাব কষার জন্য ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন ফাইনান্সিং গ্লোবাল এডুকেশন অপরচুনিটি নামে একটি অতি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গঠিত হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, সরকারের মন্ত্রী, অমর্ত্য সেন ও কৈলাশ সত্যার্থীসহ পাঁচজন নোবেল বিজয়ী এবং ব্যবসা, উন্নয়ন, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুনিয়ার নামীদামি অনেক লোক ছিলেন। এই হাইপ্রোফাইল কমিটি ছাড়াও ইউনেসকো ও অন্যান্য সংস্থা হিসাব-নিকাশ করেছে। কিন্তু হিসাব শেষে টাকার অঙ্ক দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ! 

নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো সরকারি ও পারিবারিক ব্যয় মিলিয়ে শিক্ষার জন্য এখন বছরে মোট ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ২০ হাজার কোটি) ডলার ব্যয় করছে। আগে উল্লেখ করা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে এই দেশগুলোকে শিক্ষার ব্যয় প্রতিবছর এমনভাবে বাড়িয়ে দিতে হবে, যেন ২০৩০ সালে এই ব্যয়ের পরিমাণ আড়াই গুণ বৃদ্ধি পেয়ে বছরে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এ জন্য নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোকে শিক্ষায় সরকারি ব্যয় গড়ে প্রতিবছর শতকরা ৭ শতাংশ করে বাড়িয়ে যেতে হবে। এভাবে সরকারি ব্যয় বাড়লে মধ্য আয়ের দেশগুলোয় শিক্ষায় প্রয়োজনীয় অর্থের সিংহভাগ জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু বছরে শতকরা ৭ শতাংশ হারে শিক্ষায় সরকারি ব্যয় বাড়ালেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় অনেক টাকার ঘাটতি থেকে যাবে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য বিদেশি সাহায্যের দিকে তাকানো হচ্ছে।

তিন. 
বর্তমান সহস্রাব্দ শুরুর দিকে সেনেগালের ডাকারে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে সব দেশের প্রতি শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর অনেক দেশের শিক্ষার বরাদ্দ এর ধারেকাছেই যাচ্ছিল না। তাই ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্চনের বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে নতুন আহ্বান এল—শিক্ষায় জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশ আর বার্ষিক বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ব্যয় নিশ্চিত করে। কিন্তু এখনো অবস্থার তেমন হেরফের হয়নি। এখনো অন্তত তিন ডজন দেশে শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ জিডিপির ৪ শতাংশের আর জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশের কম। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশও এই তালিকায় আছে। 

শিক্ষার জন্য টাকার টান পড়ার বিচিত্র কারণ থাকে। পশ্চাৎপদ কিছু দেশের একনায়কদের সোজাসাপ্টা হিসাব—তারা হীরক রাজার মন্ত্রে দীক্ষিত ‘এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে’। রাস্তা, ব্রিজ, দালানের মতো শিক্ষায় বিনিয়োগের ফল হাতেনাতে পাওয়া যায় না বলে কোনো কোনো সরকারের এই বিনিয়োগে আগ্রহ কম। তবে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার চেয়ে অন্যান্য খাতের গুরুত্ব বেশি বিবেচিত হয়। ফলে শিক্ষার টাকায় টান পড়ে। এ কারণে এসব দেশে শিক্ষামন্ত্রীকে হামেশাই অর্থমন্ত্রীর দুয়ারে ধরনা দিতে হয়।

চার. 
২০১৫ সালে শিক্ষায় বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কমিশনের হিসাবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ঘাটতি মেটাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন হবে। কমিশন উন্নত দেশগুলোকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ দরিদ্র দেশগুলোকে উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে প্রদান করে। আর এই সহায়তার ১৫ শতাংশ যেন শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। উচ্চ আয়ের দেশগুলো নিম্ন আয়ের দেশের শিশুদের শিক্ষার জন্য তাদের মুঠো কতটুকু আলগা করে, তা দেখার বিষয়।

তবে শিক্ষায় বিদেশি সাহায্যপ্রবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা দেখে আশাবাদী হওয়া যায় না। খুব কম দেশই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ উন্নয়ন সাহায্য দেয়। আবার অনেক বছর ধরে শিক্ষায় বৈদেশিক সাহায্য কমছে, বাড়ছে অন্য খাতে। উপরন্তু, শিক্ষার জন্য বিদেশি সাহায্য যাদের বেশি দরকার, তা তাদের কাছে যায় না। ২০১৪ সালে শিক্ষার জন্য যত বৈদেশিক সাহায্য এসেছে, তার মাত্র ২৪ শতাংশ পেয়েছে নিম্ন আয়ের দেশগুলো। শিক্ষা খাতে দেওয়া বৈদেশিক সাহায্যে আবার এক শুভংকরের ফাঁকি আছে। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, শিক্ষার নামে যে বৈদেশিক সাহায্য আসে, তার ৭০ শতাংশের কম গ্রহীতা দেশে পৌঁছায়। বাকি অর্থ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষা বৃত্তি হিসেবে দাতা দেশেই ব্যয় হয়!

পাঁচ. 
ব্রিটেনের সাবেক রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সভাপতিত্বে উল্লিখিত হাইপ্রোফাইল কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বৈদেশিক সাহায্যের অপ্রতুলতা, অকার্যকারিতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করলেও যে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক শর্তগুলো বৈদেশিক সাহায্য নিয়ন্ত্রণ করে, সে বিষয়ের উল্লেখ নেই।

কমিশন শিক্ষায় অর্থায়নের নতুন নতুন উৎস ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। পরিকল্পিতভাবে অপচয় হ্রাস করে শিক্ষার টাকা খরচ করার পরামর্শ দিয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়নের বর্তমান ঘাটতি মেটাতে বিশ্বের বিপুল সামরিক ব্যয় হ্রাস করার জন্য দুনিয়ার শান্তিকামী নানা মহল দাবি জানিয়ে আসছে। নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই বিশ্বের আট দিনের সামরিক ব্যয় দরিদ্র দেশের শিক্ষায় ব্যয় করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, বিভিন্ন শান্তিবাদী গ্রুপ হিসাব কষে বের করেছে, বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয় থেকে মাত্র আট দিনের ব্যয় (২০১৬ সালের হিসাবে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) হ্রাস করে শিশুদের শিক্ষায় ব্যয় করা হলে বিশ্বের প্রতিটি শিশুর জন্য বিনা মূল্যে ১২ বছর শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু বিশ্বের অসহায় দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য টাকা পাওয়ার পথ বাতলানোর জন্য গঠিত অসংখ্য তারকাখচিত কমিশন এসব হিসাব–নিকাশ নিয়ে সময় নষ্ট করেনি!

বাংলার একটি প্রবাদ আছে, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের জন্য, সব শিশুর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জুতসই ও টেকসই শিক্ষার জন্য যে বিপুল পরিমাণ টাকা লাগবে, সে টাকা কোন কোন গৌরী সেন জোগায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব

 

সূত্র: প্রথম আলো

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0088291168212891