করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে সর্বস্তরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকার মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে তা বিভিন্ন মেয়াদ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে সর্বশেষ ৩১ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখার আভাস দিয়েছেন। অবশ্য সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠদান কর্মসূচি চালু করেছে। প্রথম দিকে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান কর্মসূচি শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু করা হয়। বুধবার (১৩ মে) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিশোর বাতায়ন নামক একটি শিক্ষামূলক সাইটে সংসদ টিভিতে সম্প্রচারকৃত ভিডিও আপলোড করা হয়। এর মাধ্যমে শহর ও গ্রামের সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থী লাভবান হলেও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা এ প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়। বাস্তবিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকলে দেশ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রদান উত্স টিউশন ফি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে ৩৯০ কোটি টাকা প্রণোদনা দাবি করেছে। তাছাড়া কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যার শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৪০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী বেতন না পাওয়ার কারণে দুস্থ অবস্থায় জীবন-যাপন করছেন। তাদের সংগঠনের নেতারাও সরকারের কাছে এসব প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ৫০ কোটি টাকা প্রণোদনা দাবি করেছেন, অন্যদিকে ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীও তাদের দৈন্যদশা তুলে ধরে প্রণোদনা দাবি করেছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাড়িভাড়া, আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বহন করা দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে।
এসডিজি-৪ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনার কথা থাকলেও সরকার অর্থনৈতিক কারণে তা করতে পারছেন না। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে যারা সরকারের এই ব্যবস্থায় সহযোগিতা করছেন, তাদের অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শুধু শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই নয়, অদূর ভবিষ্যতে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি। এতে চাকরির সংকট দেখা দেবে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়বে।
আমাদের দেশ প্রতিবছর বিশেষজ্ঞ ও পরমর্শ ফি বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়, বিশ্বমানের শিক্ষা অর্জিত হলে হয়তো এই টাকা দেশেই থেকে যেত। উপরন্তু দেশে বসেই বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার উপার্জন সম্ভব হতো। বিশ্বমানের শিক্ষার জন্য বাজেট পর্যন্ত অর্থ বরাদ্দসহ মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে না পারলে এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
এমনিতেই বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এই প্রতিষ্ঠানের মতে, শিক্ষার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিলেও দক্ষভাবে ব্যবহারে বিশ্বের ১৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। এমনকি শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, তৃতীয় শ্রেণির ৩৫ ভাগ শিশু ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারে না। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে শিক্ষায় খরচ কম। এ অবস্থায় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ না করলে শিক্ষার গুণমান আরো নিম্নমুখী হবে। স্বাভাবিক বিকাশ ও শিক্ষার পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সেশন জটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সরকার এই ব্যবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য তত্পর। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে বাকি দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিতে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে আগ্রহী। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস ৪০ মিনিটের পরিবর্তে ১ ঘণ্টা করার পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন। তবে লকডাউনের কারণে মাসের পর মাস শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া ছাড়া থাকতে পারে না। ২০ থেকে ২৫ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাবঞ্চিত হলে এবং শিক্ষা গ্রহণের স্বাভাবিকতা নষ্ট হলে এই সংকট দূর করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তাই বিদ্যালয়ভিত্তিক, আঞ্চলভিত্তিক বাস্তব পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি, দূরশিক্ষণ পদ্ধতি, অনলাইন পদ্ধতি, রেডিও, টিভি যেখানে যে পদ্ধতি বাস্তবসম্মত, তা বিবেচনা করে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই এ জাতি অপূরণীয় ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে।
লেখক : ড. দেওয়ান আযাদ রহমান, গবেষক ও প্রবন্ধকার