শিক্ষায় গবেষণার প্রয়োজনীয়তা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষায় গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

গবেষণা বলতে বুঝায় পুনঃপুন অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিরাজমান সমস্যা নিরসনকল্পে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন। গবেষণা বিশেষ যুক্তিপূর্ণ নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব খোঁজাই হচ্ছে এর লক্ষ্য। শিক্ষা অর্জন সকল মানব শিশুরই একটি মৌলিক অধিকার। উন্নত সমাজ গঠনের প্রধান হাতিয়ার হলো শিক্ষা, যা ব্যক্তির সহজাত বৈশিষ্ট্য ও সৃজনশীল মননের বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী করে তোলে। গবেষণালব্ধ যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োগ করে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। আমাদের নতুন প্রজন্ম যদি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করে নিজেদেরকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তা হলেই দেশের দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং একটি উন্নতও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি হবে। এই লক্ষ্যে গবেষণাপূর্বক চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক।

বর্তমান বিশ্বে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি। দক্ষ জনসম্পদ গড়ার প্রধান নিয়ামক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, যুগোপযোগী কারিকুলাম, পাঠদান পদ্ধতি, যথাযথ মূল্যায়ন, শিক্ষাপ্রশাসনে সুশাসন ইত্যাদি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়গুলো অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় আনা উচিত। শিক্ষা নিয়ে যে গবেষণার দরকার রয়েছে তার সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আর শিক্ষা যে গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে সে বিষয়ে আমাদের ধারণাও অনেক কম। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চ’ নামক প্রতিষ্ঠানটিশিক্ষার সকলস্তরে ধারাবাহিক গবেষণা  এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাছাড়া, ব্রিটিশ ‘এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন’ মনে করে, বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন নির্ভর করে গুণগত ও উচ্চমানের শিক্ষাসংক্রান্ত গবেষণার ওপর। এ কারণে এই গবেষণা-সংস্থাটি ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস ও গবেষণার মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিতকরণ ও বিশ্লেষণ করে নতুন ধারণা বা পদ্ধতি উপস্থাপন করে।

শিক্ষা-গবেষণা ও শিক্ষা বিষয়ক গবেষকদের গুরুত্ব অনুধাবন করে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে শিক্ষা নিয়ে পড়া ও গবেষণা করার জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। বিষয়টি আমাদের দেশেও ভাবা যেতে পারে। কারণ গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে না উঠলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে রাষ্ট্র-উন্নয়নে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ‘আমেরিকান এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন’ শিক্ষা-উন্নয়নের জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত অগ্রগতি সম্পর্কে মানুষকে উৎসাহিত করে এবং শিক্ষাবিষয়ক গবেষণার ফলাফল শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। শিক্ষার গুণগতমান বজায় রাখা, কম মেধাসম্পন্ন ও অধিক মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স সমস্তরে নিয়ে আসা, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণাকরে থাকে। শিক্ষা কার্যক্রম ও পরিকল্পনাকে গতিশীল করা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও মূল্যায়ন পদ্ধতিকে গ্রহণযোগ্য করা এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। ‘ইউরোপিয়ান এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন’ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা গবেষকদের গ্রুপ রিসার্চ করতে অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষাবিষয়ক গবেষকদের সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউরোপের কাউন্সিল অব এডুকেশন, ওইসিডি এবং ইউনোস্কোর মতো ইন্টারন্যাশনাল সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে কাজ করে এবং শিক্ষাসংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ, প্রচার ও অনুশীলনের পরামর্শ দান করে। 

জাপানে বর্তমানে শিল্পপতিরা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। টেকনোলজি-ভিত্তিক শিল্পায়নের নিমিত্তে কোরিয়া ও তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন লক্ষণীয়। একটি হতদরিদ্র ছোট দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। দেশটি ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ আগস্ট স্বাধীনতালাভ করে মাত্র ৫২ বছরে মানুষের গড় আয় ৩২০ মার্কিন ডলার থেকে বর্তমানে ৬০ হাজার মার্কিন ডলারের উপরে উন্নীত করেছে। শুরুতেই দেশটিতে শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। উন্নতির স্বার্থে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে শিল্পায়নের জন্য দক্ষ, উচ্চশিক্ষিত মানবসম্পদের প্রয়োজন হলে শিক্ষা-পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। একপক্ষীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে বহুধারার শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই শিক্ষাদান পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। শিক্ষকদের প্রমোশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার পরিবর্তে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। পশ্চিমা দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, প্রকৌশল, টেকনোলজি ও প্রশাসনিক বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষকতা ও গবেষণার জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দেয়া হয়। শিক্ষকরা পাঠদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করে এবং জ্ঞান সঞ্চালকের পরিবর্তে ফ্যাসিলিটেটরের ভূমিকা নেয়। শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতির পরিবর্তে ছাত্রকেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতি ও গ্রুপ ওয়ার্ক পদ্ধতি শুরু করেন। ক্লাসে ছাত্রদের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হলে তার কারণ অনুসন্ধান করে শিক্ষকরাই তার সমাধান  করেন।  এভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থায়- একটি সহনশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তা ও জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের আকাঙ্ক্ষার অধিকারী এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক যুবকশ্রেণি গঠন করতে সক্ষম হয়।

আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ হলো সমাজ, ধর্ম ও অর্থনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে অধীত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যথাযথ জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মধ্যে গবেষণার মাধ্যমে চাহিদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে ৪৩টি পাবলিক ও ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে ৩৬ লাখের অধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পড়াশোনা করছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে গবেষণা ক্ষেত্রটি আমাদের দেশে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। আর যেটুকু গবেষণা হচ্ছে তারও বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা যত বেশি আলোচনা করছি, শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে সেভাবে আলোচনা করছি না। গবেষণার জন্য প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেন্টার অব এক্সিলেন্স গঠন করা যেতে পারে, যা ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষকদের রিসার্চ ল্যাবরেটরি হিসেবে কাজ করবে। 

শিল্পায়নের শুরুতে পাশ্চাত্যের ও আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকদের গবেষণার বাণিজ্যিকীকরণের ধারা গ্রহণ করে এবং এ সময়ে প্রায়োগিক গবেষণার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিক্ষকদের গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অনেক ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে ওঠে।
আমেরিকায় সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে ওঠে তখনই যখন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে একটি নতুন প্রোগ্রাম চালু করে। জাপানের শিল্পপতিরা উপলব্ধি করেন, শিক্ষকরা এ ব্যাপারে বেশি উপযুক্ত এবং তাঁদের গবেষণার ফলাফল ইন্ডাস্ট্রির জন্য অধিকতর কাজে লাগবে। চীনে চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের অধীনে এ ধরনের অনেকগুলো গবেষণা গ্রুপ কাজ করে থাকে। 

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি এবং ইউটিলিটারিয়ান বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে। কাজেই শিক্ষানীতি প্রণয়নের আগে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে ধারাবাহিক গবেষণা দরকার। শিক্ষার বিভিন্ন দিক, যেমন শিখন, শিক্ষাদান-পদ্ধতি, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ এবং শ্রেণিকক্ষ-ব্যবস্থাপনাসহ অনেক ক্রিটিক্যাল ইস্যুগবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। দুইভাবে গবেষণা প্রক্রিয়া অনুসৃত হতে পারে, তা হলো গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণা। গুণগত গবেষণার প্রকৃতি বর্ণনামূলক হয়, যেখানে অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ-ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের গবেষণাগুলো পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ,কেস স্টাডি, এথনোগ্রাফি ও ইতিহাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। পরিমাণগত গবেষণা তথ্য ও উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাছাড়া কর্মসহায়ক গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানিক সমস্যার কার্যকরী সমাধান দেয়া সম্ভব। কর্মসহায়ক গবেষণা জ্ঞান অনুসন্ধান, পেশাগত চর্চার উন্নয়ন এবং পেশাদার ব্যক্তির দক্ষতা বিকাশ এই তিনটি বিষয়ে সম্পর্ক জোরালো করে। 

সামাজিক গবেষণায় কর্মসহায়ক গবেষণা একটি নবতর সংযোজন। চল্লিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষায় কর্মসহায়ক গবেষণা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। গত তিন দশক ধরে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক কর্মসহায়ক গবেষণা আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে কোনো শিক্ষক নিম্মোক্ত বিষয়ে কর্মসহায়ক গবেষণা পরিচালনা করতে পারেন, যেমন- প্রচলিত শিক্ষণ-শিখনপদ্ধতি ও মূল্যায়ন-পদ্ধতির পরিবর্তন; শ্রেণিকার্যে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ; শ্রেণিতে শিক্ষণ-শিখন কার্য চলাকালীন শিক্ষার্থী কর্তৃক প্রশ্নকরণেশিক্ষার্থীর প্রেষণা সৃষ্টি করা; শিক্ষার্থীর সময়মতো এবং নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ; শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন; বিদ্যালয়-ভিত্তিক মূল্যায়ন; শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিথস্ক্রিয়ার উন্নয়ন; একীভূত শিক্ষণ বাস্তবায়ন; শিক্ষক প্রশিক্ষণের ফলপ্রসূতা; শিক্ষার্থীদের পাঠে অমনোযোগিতা; শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের অনভিপ্রেত আচরণ; শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা বজায় রাখা ইত্যাদি। বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকে প্রতিষ্ঠানই শিক্ষা নিয়ে গবেষণার প্রয়াস চালাচ্ছে। যেমন- ব্যানবেইস, ব্র্যাক, প্লান বাংলাদেশ, নায়েম, বিআইডিএস, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, গণস্বাক্ষরতা অভিযান, শিক্ষা সংবাদ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। কাজেই এ ধরনের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ফলাফল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মান্ধাতার আমলের শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত, তাই গুণগত পরিবর্তন আনায়ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রত্যেকের নিজ নিজ গণ্ডিতে থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করা উচিত। প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি চিন্তা  করেন প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীই তাঁর কাছে আমানত, কোন শিক্ষার্থী কী কী অসুবিধার জন্য গুণগত শিক্ষা পাচ্ছে না, কোন কোন কারণে শিক্ষার্থীরা বিপদগামী হচ্ছে, কোন শিক্ষক দায়িত্বশীল নয় বা কোন শিক্ষক অসুবিধায় রয়েছে, তবেই তো ভালো প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী তৈরি করা সম্ভব। মাধ্যমিকস্তরে একীভূত শিক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে। গবেষণায় দেখা গেল প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাঠদান করার জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো ও শিক্ষকের অভাব রয়েছে, ফলে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। বর্তমানে একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না, উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা পছন্দ অনুযায়ী বিভাগ নির্ধারণ করতে পারবে। পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে এবং শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের সংখ্যা বাড়িয়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে।এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিকস্তরের সববিষয়ে জ্ঞান লাভ করবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের উৎপাদনমুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু হয়েছে তারও ফলপ্রসূতা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। গবেষণার ফলাফলের ওপর বিচার-বিশ্লেষণ করে শিক্ষানীতি যদি প্রণীত হয় তবে শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আসতে বাধ্য। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল জীবন থেকেই প্রজেক্ট বেইজড বা গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীরা শিল্প, কৃষি-খামার, ছোটখাট ব্যবসা, যোগাযোগ, সাক্ষরদান কর্মসুচি, ইত্যাদি বিষয়ে প্রজেক্টভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে নম্বর পেতে পারে। কাজেই শিক্ষাকে আত্মকর্মসংস্থানমূলক ও ব্যবহার উপযোগি করার নিমিত্ত শিক্ষা-গবেষণার জন্য জাতীয় নীতিমালা এবং বিভিন্ন শিক্ষা স্তরে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা জরুরি। 

বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া। পৃথিবীর কোনো দেশ উন্নতমানের গবেষণার অবকাঠামো তৈরি না করে ধনী দেশে পরিণত হয়নি। দেশকে স্বনির্ভর করতে এবং দেশের নাগরিকদের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা প্রদানে গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা ও গবেষণার যোগ্যতা পরিমাপ করার সঠিক মানদণ্ড না থাকায় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা গবেষণায় মনোযোগ দেন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই গবেষণার কাজে আগ্রহী নন। মানসম্মত প্রকাশনার সংখ্যাও অপ্রতুল, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত পরিচালিত হচ্ছে ‘টিচিং’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। শিক্ষক নিয়োগে সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষার পরিবর্তে শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক ও গবেষণাভিত্তিক বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, গবেষণা করছেন এ রকম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীদের নিয়োগে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো আমাদের দেশেও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষকতা এবং তথাকথিত মুখস্থনির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে সমস্যা সমাধান-নির্ভর শিক্ষায় জোর দিতে হবে। গবেষণায় আজকের ছোট ছোট পদক্ষেপ একদিন আমাদের দেশের গবেষণা-খাতকে বৈশ্বিক দরবারে উঁচু স্থানে নিয়ে যাবে। 

শিক্ষার মান যাচাই বা শিক্ষার মূল্যায়ন-পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা দরকার। ভারত ও পাকিস্তানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল চালাচ্ছে, যেন তাদের সন্তানরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। আর আমাদের এখানে ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করা হচ্ছে।  পৃথিবীর বুকে যোগ্য মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে ইংরেজি ভাষাকে কিছুতেই ছাড়া যাবে না। তাছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীরা না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা। বর্তমানে ইংরেজি, বাংলা, গণিত ভালো জানে এরূপ শিক্ষকের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা অনতিবিলম্বে রোধ করা দরকার। এই পঙ্গু শিক্ষাব্যবস্থা বংশ পরম্পর চলতে থাকলে ভবিষৎ পরিকল্পনাসমূহ অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই বিশ্বায়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকলেরই একযোগে কাজ করা উচিত।

লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0083649158477783