শিক্ষিকা থেকে ব্যবসায়ী নেত্রী - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষিকা থেকে ব্যবসায়ী নেত্রী

এম এম মাসুদ |

ড. রুবানা হক। শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করেছিলেন কর্মজীবন। স্বামীর ব্যবসার সূত্রে পা দেন বাণিজ্যের জগতে। স্বামীর অবর্তমানে দায়িত্ব নিয়েছেন পুরো একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের। ২০ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন বলে খ্যাত তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। শ্রমিক অধিকার, নারীর উদ্যোগ ও তৈরি পোশাক খাতসহ নানা বিষয়ে সোজাসাপ্টা কথা বলতে অভ্যস্ত একজন সদালাপী রুবানা এবার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সর্বোচ্চ পদে। আর এ দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম বারের মতো একজন নারী এই সংগঠনের সভাপতি হচ্ছেন। বিজিএমইএতে আগামী দুই বছর নেতৃত্ব দেবেন তিনি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সহধর্মিনী রুবানা মোহাম্মদী গ্রুপের কর্ণধার। এ ব্যবসায়ী গ্রুপের ২১টি ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত।

ড. রুবানা হকের জন্ম ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি। পড়াশুনা করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল, হলিক্রস কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরুষোত্তম লালের প্রকাশনা সংস্থা ও রাইটারস ওয়ার্কশপের ওপর ‘রাইটারস ওয়ার্কশপ: এজেন্ট অব চেঞ্জ’ বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল নিয়ে এমএ করেন। মেধাবী এই নারী এসএসসি, এইচএসসিতে বোর্ড সেরা হয়েছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চার সঙ্গেও জড়িত। মানবজমিনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে।

রুবানা হকের প্রয়াত স্বামী ও ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ব্যক্তি জীবনে একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আনিসুল হক তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুলের তৈরি পোশাক ছাড়াও বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা রয়েছে। ডিজি জাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড এবং নাগরিক টেলিভিশনের মালিকানাও এই গ্রুপের।

রুবানা হকের তিন সন্তানের মধ্যে, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে নাভিদুল হক এবং মেয়ে ওয়ামিক উমাইরা ও তানিশা ফারিয়ামান হক মোহাম্মদী গ্রুপের পরিচালক। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ‘দেশ এনার্জি লিমিটেডের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন নাভিদুল। নাভিদুল হক বোস্টনের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ওয়ামিক উমাইরা স্নাতক শেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের সিমন্স কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন তানিশা ফারিয়ামান।

ড. রুবানা হক ৫৫ বছর বয়সে অনেক কিছু অর্জন করেছেন। এক সময় টিভিতে উপস্থাপনা করেছেন। ২০০৬ থেকে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সাউথ এশিয়া টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর ট্রাস্টি মেম্বার। ২০১৩ ও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ নারী নিবন্ধে তার নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্যবসার পাশাপাশি রুবানা হক সাহিত্যচর্চাও করেন। ‘টাইম অব মাই লাইফ’ তার লেখা কবিতার বই। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কবিতার জন্য সার্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। সম্প্রতি তিনি ইংরেজি সাহিত্যেও পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। 

ড. রুবানা হক জানান, পড়ালেখার দিকেই বেশি আগ্রহ তার। ব্যবসার প্রতি কখনোই আগ্রহ ছিল না। স্বামী আনিসুল হকও কখনো চাইতেন না তিনি ব্যবসায় আসেন। ব্যবসায় আসার আগে রুবানা হক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এটি তিনি উপভোগ করতেন। আনিসুল হকের ব্যবসাও ভালোই চলছিল। হঠাৎ অতিরিক্ত কাজের চাপে আনিসুল হকের উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। দুজনে একদিন চিকিৎসকের কাছে গেলেন। চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন কাজের চাপ কমাতে।

বাড়ি ফিরেই রুবানার সাহায্য চাইলেন আনিসুল হক। সে সময় আনিসুল হকের ব্যবসায়ীক অংশীদার হিসেবে স্ত্রী ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন না। কখনো অফিসেও আসতেন না। ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর রুবানা হক শুরুতে মতিঝিলের অফিসে গিয়ে বসতেন। ধীরে ধীরে ব্যবসার কাজে যুক্ত হন। বর্তমানে ২১টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি।

কিন্তু এই ব্যবসায়ী হওয়ার আগে স্বামীকে শর্ত দিয়েছিলেন, যতই ব্যবসা দেখি না কেন, আমি কিন্তু পিএইচডি করবই। অবশ্য রুবানা হক ব্যবসা সামলানোর সঙ্গেই সঙ্গেই পিএইচডি করেছিলেন। তাকে কেউ ড. রুবানা বললে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন। তবে তার সবচেয়ে বড় যে গুণ, ব্যবসায়িক বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এমনকি আনিসুল হকও অবাক হয়ে বলতেন, ‘এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও কী করে?’ প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীদের কাছে তিনি মায়ের মতো। কার কী প্রয়োজন, কার কোথায় সমস্যা, সেগুলো তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। এমনকি পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যাতে তারা সময়মতো বেতন পান, সেটাও গুরুত্ব দিয়ে তিনি নিজে বিবেচনা করেন। 

রুবানা হক একজন সৃজনশীল মানুষও। কবিতা লেখেন, প্রবন্ধ লেখেন, কবিতা লিখে পেয়েছেন সার্ক সাহিত্য পুরস্কার। সময় পেলে মোমবাতি তৈরি করেন। এটা তার বিশেষ শখ সেই ছোটবেলা থেকেই। নিজের বাড়িতেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় মোমবাতি সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। এছাড়া রাতে মোমের আলোতেই নানা কাজ করেন।

সম্প্রতি বিজিএমইএ নতুন কমিটির প্রধান ও প্রথম নারী সভাপতি হতে যাওয়া রুবানা হক বলেন, দেশের পোশাক খাতের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি সঙ্কট কাটিয়ে উঠা, পণ্যের দাম বাড়াতে দর কষাকষি, কারখানা পূর্ণসংস্কার শতভাগ করা, পেশাক খাতের টেকসই উন্নয়ন, প্রযুক্তি নির্ভর বাড়িয়ে দেয়া ও মালিক-শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অগ্রধিকার দেবেন তিনি। 

রুবানা হক বলেন, বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম কাজ হবে পোশাক খাতের ভাবমূর্তির ঘাটতি কাটিয়ে উঠা। বাংলাদেশ সস্তায় পণ্য দিচ্ছে বলে যে কথা প্রচলিত আছে সেটা বদলাতে হবে। সস্তায় কখনও ভালো জিনিস হয় না। শব্দটি হবে ‘কম্পারেটিভলি গুড প্রাইস’, সেই ট্রেন্ড চালু করতে আমাদের কাজ করতে হবে। দামের ব্যাপারে দর কষাকষিতে কখনই ছাড় দেয়া যাবে না। বিজিএমইএ থেকে আমি এবং আমার প্যানেল সেই লক্ষ্যে কাজ করার উদ্যোগ নিতে পারি। যদি কারখানাগুলো মনে করে, দর কষাকষির ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য লাগবে আমরা তাহলে অবশ্যই নেগোসিয়েট করে দেব। সেটার জন্য আমরা আলাদা একটা সেল করব। 

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সম্পর্কে নিজের ভাবনা তুলে ধরে রুবানা হক বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অনেকগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাদের সবার কষ্ট হচ্ছে। দ্রুত তাদের পক্ষে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
 
গার্মেন্ট মালিকদের প্রতি আহ্বান রেখে তিনি বলেন, নিজেরা যেন একজন অন্যের বিরুদ্ধে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হই সেটাই হবে চ্যালেঞ্জ। সঠিক দামে পৌঁছাতে না পারলেও ফ্যাক্টরির চাকা চলতে হবে বলে অল্প দামে অর্ডার নিয়ে নেয়া ঠিক হবে না। এই জায়গাটায় আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ ক্রেতারা যতই বলুক উনারা চলে যাবেন, আসলে উনারা যেতে পারবেন না। কারণ বাংলাদেশের মতো এমন দাম অন্য কোনো দেশ অফার করতে পারবে না।

পোশাক খাতে অগ্রগতি নিয়ে রুবানা হক বলেন, রানা প্লাজার মতো বিব্রতকর ঘটনার পরও পোশাক শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে কমপ্ল্যায়েন্ট হিসেবে আমরা নিজেদের দাবি করতে পারি। মুশকিলটা হলো- আমরা কম রেটে কাজ করি, তাই আমাদের মূল্য সংযোজন নাই ও এই ভ্যালু এডিশনের জন্য গবেষণাও ঠিকমতো করতে পারছি না। ভালো পণ্য তৈরি করতে পারছি না। আমাদের ভালো ফ্যাশন ইনস্টিটিউট নেই। একটি আছে- ওটিও এত ভালো না। এছাড়া নতুন অনেক কারখানা হয়েছে- গ্যাস নাই, বিদ্যুৎ নাই। এই জায়গাগুলোতে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। 

তিনি বলেন, আমাদের গার্মেন্টে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। কিন্তু নারী উদ্যোক্তা তিনজনও নেই। এছাড়া আমরা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলি, কিন্তু যখন ট্রেড ইউনিয়নে যাই সেখানে একজনও নারী নেত্রী নাই, নারী সুপারভাইজার নাই। তিনি বলেন, সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করি, আমরা দুই বছরে বহু কিছু পাল্টে দিতে পারব। 

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035901069641113