শিক্ষিত গভর্নিং বডি, শিক্ষা বোর্ডের উদ্ভট দাবি! - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষিত গভর্নিং বডি, শিক্ষা বোর্ডের উদ্ভট দাবি!

মুহাম্মদ হযরত আলী |

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষিত ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি চায় শিক্ষা বোর্ড। সম্প্রতি দৈনিক শিক্ষাসহ একাধিক সংবাদপত্রে আলোচিত এ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া গত কিছুদিন যাবৎ ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে জোরালো আলোচনাও চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা বোর্ড শিক্ষিত ম্যানজিং কমিটির চাহিদা প্রকাশ করেছে। মহান জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি এবং মাননীয় মন্ত্রীদের বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

জন প্রতিনিধি বা সাংসদ ও মন্ত্রীগণ যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করতেই পারেন, তাতে দোষের কিছু নেই। কেননা তাদের আলোচনার দ্বার সর্বাবস্থায় উম্মুক্ত। তারা আলোচনা, পর্যালোচনা এবং স্টেক হোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতেই বিভিন্ন বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করেন। কিন্তু শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা তো জনপ্রতিনিধি নন; তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের কাজ হলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকারের পলিসি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা প্রদান করা। তারা শিক্ষিত গভর্নিং বডি চাইবেন, এ ধরনের উদ্ভট দাবি, প্রস্তাব বা সুপারিশ কোনোটাই প্রত্যাশিত নয়। 

কেননা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির অধিকাংশ সদস্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কমিটি গঠন ১৯৭৭ বা ২০০৯ উভয় নীতিমালাতেই একই ধরনের বিধি রয়েছে। এতে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো শর্ত উল্লেখ নেই। ভবিষ্যতে নতুন বিধান করা হলে সেখানেও গণতান্ত্রিক পথে সদস্য নির্বাচনের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে এবং বর্তমান বিধানের অধিকাংশ ধারা বহাল থাকবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে মহান জাতীয় সংসদের সদস্য পদে নির্বাচনের জন্য যে সমস্ত যোগ্যতার বর্ণনা করা আছে, তাতে কোথাও কোনো প্রকার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ নেই। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনসহ কোনো ক্ষেত্রেই নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো শর্ত নাই। তাহলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষিত পরিচালনা কমিটির দাবিটি কি আদৌ যুক্তি সংগত?

বোর্ড কর্মকর্তাদের দাবি হলো- অশিক্ষিত লোকেরা কমিটিতে এসে শিক্ষকদের অসম্মান করেন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটে। বোর্ড কর্মকর্তাদের এ দাবিটি আমরা যথার্থ মনে করি না। কারণ আমাদের জানামতে, এ যাবৎ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান বোর্ডের কাছে এ ধরনের কোনো নালিশ বা অভিযোগ দিয়েছেন বলে আমরা শুনি নাই। 

তবে পরিচালনা কমিটির অনৈতিক দাবি, পেশীশক্তির দাপট, সামাজিক প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক কূটকৌশল ও আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় অনেক অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অনাহূত, অনাকাঙ্ক্ষিত চাপের মুখে অহরহ জ্বালা-যন্ত্রণা এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যার প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা শিক্ষা বোর্ডের হাতে নেই। বর্ণিত ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিচালনা কমিটির সদস্য বা সভাপতিরা অধিকাংশই শিক্ষিত এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ফলে শিক্ষিত কমিটি হলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ভালো হয়ে যাবে এ ধরনের আশা করা দুরাশারই নামান্তর। 

আমি ইতোপূর্বে "বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির বিকল্প প্রয়োজন" শিরোনামে একটি মতামত লিখে ছিলাম, যা একাধিক অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং আমার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতেও লেখাটি আপলোড করা আছে। সেখানে আমি যা বলতে চেয়েছি তা হলো- বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা) কর্মচারীদের এমপিওর বরাদ্দসহ প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের উন্নয়ন মঞ্জুরি প্রদান, এনটিআরসিএর সুপারিশের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা, তাদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাসহ সামগ্রিক বিষয়ে দেখভাল করে শিক্ষা অধিদপ্তর।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজে পদে পদে জবাবদিহি করতে করতে শিক্ষকদের নাকাল অবস্থা। কিন্তু একাডেমিক বিষয়ে চলছে রাম রাজত্ব। কোচিং, প্রাইভেট, শিক্ষকদের রাজনীতি আরও কত কি, যা সকলেরই জানা আছে, তাই এখানে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করছি না। 

বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষিত কমিটির চাহিদা পেশ না করে একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজস্ব বলয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সামগ্রিক দায় দায়িত্ব কীভাবে শিক্ষা বোর্ডের হাতে নেয়া যায় তার সুচিন্তিত মতামত ও সুপারিশ সরকারের নিকট পেশ করতে পারেন। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে কাঙ্ক্ষিত সময়ের পূর্বেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ঈর্ষণীয় সফলতার আশা করা যায়।

আর্থিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বহীন শিক্ষা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত পরিচালনা কমিটি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার থাকবে, এর কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। তাই পরিচালনা কমিটির নীতিমালা সংশোধনের আগে কমিটি অনুমোদনের দায়িত্বটি বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে ন্যস্ত করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। 

যেহেতু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত আর্থিক দায়ভার এখন সরকার বহন করছে, সেহেতু শুধুমাত্র বেসরকারি নামের অভিশাপের কারণে গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির অধীনে রাম রাজত্বের ন্যায় বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। তাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে শুধুমাত্র একাডেমিক বিষয়াদি দেখভাল ও সামাজিক সহযোগিতার জন্য মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রয়োজনে শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়ে পরিচালনা কমিটি গঠনের বিধিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সার্বিক দায়-দায়িত্ব পালন করবে শিক্ষা অধিদপ্তর।

যেহেতু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষা বোর্ডের আর্থিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব নেই, সেহেতু শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পরিচালনা কমিটির হাতে এ ক্ষমতা থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান নেই। অতএব শিক্ষা বোর্ডের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষিত পরিচালনা কমিটি নয়; বরং সরাসরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিকল্প পদ্ধতির ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি বিধিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক সম্মেলন ২০১৯ এর জেলা, উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠনের প্রস্তাব বা সুপারিশ বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। তবে এ প্রস্তাবের বেলায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত কমিটি গঠনের নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।]

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041429996490479