রাজধানীতে চলছে শিশুকে অসুস্থ বানিয়ে নিষ্ঠুর ভিক্ষা ব্যবসা। ভাড়াটে সন্তান দিয়ে হচ্ছে জমজমাট ভিক্ষা বাণিজ্য। নগরীতে চলতে ফিরতে হরহামেশাই চোখে পড়ে- এক পাল ছেলেপেলে নিয়ে হাজির ‘জনম দুঃখী’ মা, বাবা, ভাই অথবা বোন। বড় পরিবার, উপার্জনের পথরুদ্ধ- ইত্যাদি গল্প শুনিয়ে মানুষের হৃদয়ে করাঘাত করে এরা নিজেদের ঝুলি ভরে। শুক্রবার (১৯ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবুল খায়ের।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাজধানীর হাইকোর্টের পাশে জাতীয় ঈদগাঁও মাঠের শেষ দিকে গাছের নিছে শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করতেন জোৎস্না-জহুরুল দম্পত্তি। গত বুধবার অচেতন ও অসুস্থ সাত মাসের শিশু সানজিদা আক্তারকে নিয়ে তাদের ভিক্ষা করার বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ইশরাত জাহানের নজরে আসে। পরে তিনি তাদের আটক করেন। একই সঙ্গে তিনি অসুস্থ শিশুটিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
শিশুটি বর্তমানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। আটক দুইজনকে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে। জানা গেছে, শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
সরেজিমনে গিয়ে আটক জোৎস্না-জহুরুলের সঙ্গে কথা বলেন সংবাদকর্মী। দীর্ঘ ২১ বছর রাজধানীতে কীভাবে ভিক্ষাবৃত্তি করতেন তার সার্বিক বিষয় তাদের সঙ্গে কথাপোকথনে উঠে আসে। জোৎস্নার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। আর মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীতে জহুরুলের গ্রামের বাড়ি। জহুরুল গাঁজা সেবন করে। প্রেম করে বিয়ে করেন তারা।
জহুরুল বলেন, অন্য পেশার চেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেশি লাভজনক। শিশুরা যত অসুস্থ তত বেশি আয় হয়। দিনে ৩০০/৪০০ আবার কখনো এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় জড়িত পঙ্গুদের গাড়ি ঠেলে আয়ের ৫০ ভাগ টাকা তারা পান। তাদের কাছে যে শিশুটি রাখা হয়েছে তার নাম রাখা হয়েছে সানজিদা আক্তার। সাত মাস আগে পারভীন নামক এক মেয়ের কাছ থেকে শিশুটিকে ভাড়ায় নেন উল্লিখিত দম্পত্তি।
শাহবাগ থানা পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সফিউল আলম বলেন, তারা পেশাদার ভিক্ষুক। স্বামী-স্ত্রী মিলে ভিক্ষা করে। দালাল প্রকৃতির মেয়ের কাছ থেকে তারা শিশু ভাড়া নেয়। তারা অনেক বাচ্চার হাত-পা বাঁকা করে ভিক্ষা করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, শিশুদের অসুস্থ বানিয়ে নিষ্ঠুর ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করার সাহস না পায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, সোনারগাঁও, গুলিস্তানসহ দেড় শতাধিক স্থানে শিশুদের নিয়ে নিষ্ঠুর ভিক্ষাবৃত্তি চলছে। মিলন ৯ বছরের শিশু। সামনে বা পেছনে কথিত মা। তার কোলেও নিস্তেজ শিশু। সবাই মিলে ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা করছে। দেখে মনে হবে বাবাহীন কোনো পরিবার। কিন্তু ওরা আসলে কেউ আপন নয়। সবাই ভাড়াটে। ওদের কাজই ভিক্ষা করা। ভিক্ষাবৃত্তির জগতে শিশু ভাড়া পাওয়া যায়। ভাড়াটেরা মিলে হয়ে যায় এক পরিবার। এরপর চলে ভিক্ষাবৃত্তি।
এই ভাড়াটে শিশু নিয়ে ভিক্ষার পেছনে আছে শক্তিশালী একটি চক্র। এ চক্রটি শিশু চুরি থেকে শুরু করে দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা ও মাদকাসক্ত মায়েদের সন্তান ভাড়া নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি চালাচ্ছে। দিন শেষে শিশু ভাড়া হিসেবে দেড় থেকে দুশ টাকা আর কিশোরী মায়ের জন্য কিছু দিয়ে বাকি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্রটি। বিনা শ্রম আর পুঁজিতে চলছে এই ব্যবসা। আইন-শৃংখলা বাহিনী ও ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে শিশুদের দিয়ে এমন নির্মম ব্যবসা চালালেও কেউ কিছু বলে না। কোনো এক অদৃশ্য কারণে এসব সংস্থার সদস্যরা নিশ্চুপ।
মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় মিতুর। দুই বছরের মাথায় বিয়েটা ভেঙে যায়। কিন্তু ততদিনে কোলে চলে এসেছে একটি মেয়ে শিশু। জীবনের টানে একদিন সন্তান নিয়ে মিতু চলে আসে রাজধানীতে। তারপর আরও দু’বার বিয়ে করে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করেছে সে। বিয়ে টেকেনি; কিন্তু কোলে এসেছ আরও দু’টো সন্তান। সন্তান ভাড়া দিয়ে তার এখন প্রতিদিনের আয় ৬০০ টাকা। এই টাকায় মিতু মাদক সেবন করছে। মিতু আরও সন্তান চায়। প্রতি সন্তানে আয় ২০০ টাকা। যা দিয়ে পাওয়া যাবে আরও মাদক, আরও নেশা।