জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষাবিদরাও বলে আসছেন, পরীক্ষা পদ্ধতি শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত লেখাপড়ার চাপ ও ভীতি তৈরি করছে।
অর্থনৈতিক বিকাশ, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে বাঙালির চিরাচরিত যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। ফলে জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক কারণে পরিবারের সদস্যরা শিশুদের তেমন সময় দিতে পারছে না। উন্নত বিশ্বের মতো আপত্য লালন প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে শিশুর শিক্ষা-মূল্যবোধ গঠনসহ সময়যাপনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।
মিডিয়া বা নেটওয়ার্কের প্রভাবে শিশুর ওপর রয়েছে আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ের প্রভাব, যা অনেক ক্ষেত্রে দেশি মূল্যবোধের পরিপন্থি। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এমন কঠিন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ মার্চ এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা পদ্ধতি থাকবে না।
শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট অনেকেই সেই ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের উপস্থিতিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন ২৪ মার্চ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব পরীক্ষা থাকছে না।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিয়ে। জানা যায়, উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই প্রাথমিক শিক্ষার কোনো স্তরেই পরীক্ষা ব্যবস্থা নেই। জাপানিদের ভদ্রতা, নৈতিকতা ও সুস্থতার কারণ হিসেবে যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়, সেই শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না গ্রেড চারে (১০ বছর বয়স পর্যন্ত) পৌঁছায়, ততদিন তাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না।
তাদের শুধু শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। জাপানি শিক্ষাবিদরা মনে করেন, প্রথম তিন বছরের স্কুলজীবনে একজন শিশুর জ্ঞান বা শিক্ষার মান বিচার করা যায় না। জাপানের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রেড ওয়ান থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এ স্তরে শিশুকে অন্য মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি কোমল হওয়া, উন্নত চরিত্র গঠন, ভালো আচরণ, উদার, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী চিন্তা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মানবিক বাংলাদেশ আজ নতুন মর্যাদায় বিশ্বদরবারে অধিষ্ঠিত। তার নির্দেশনায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সফল বাস্তবায়নের পাশাপাশি ২০৩০ সালের এসডিজিএস মোকাবেলায়ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎপর।
প্রতিটি শিশুর জন্য জীবনব্যাপী ও গুণগত শিক্ষার উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নের পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসূচিও গ্রহণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কোমলমতি শিশুর জন্য ভীতিকর কিছু না করে আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষাদানের কথাও বলেছেন।
শিক্ষাক্রমের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় একটি দেশের শিক্ষার দর্শন এবং শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য। আধুনিক শিক্ষাক্রমে নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য উদ্দেশ্যও সুস্পষ্ট করা হয়। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যও নির্ধারণ করা হয় এবং শ্রেণি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করানো হয়।
এ ক্ষেত্রে শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষকরা শিখন-শেখানোর বিদ্যমান পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধারিত শিখন ফল অর্জন করানোর চেষ্টা করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শ্রেণি কার্যক্রমের মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী শিক্ষানীতির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ধাবিত হয়।
সে কারণে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের জন্য শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধনসহ যথাযথ মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। যথাসময়ে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারীসহ সংশ্নিষ্ট সবার যথাযথ দায়িত্বশীলতা, আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা।
আজকের শিশুকে সঠিক মূল্যবোধ ও আদর্শে গড়ে তুলতে পারলেই তারা দেশকে নিয়ে যাবে অর্থনৈতিক ও মানবিক দিক থেকে অনেক দূরে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনাও তাই।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে জেন্ডার, স্থানীয় সরকার ও উন্নয়ন গবেষক এবং পরীক্ষা মূল্যায়ন গবেষক
সূত্র:সমকাল