শিশুরা জাতির ভবিষ্যত্ নির্মাতা। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সামাজিক শিশুই নির্মল পৃথিবী গড়তে পারে। শিশুর সুন্দর শৈশব ও অনাবিল ভবিষ্যতের জন্য দরকার সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা। লেখাপড়া, খেলাধুলা এবং সুন্দরভাবে তার জীবনকে আনন্দময় করতে স্বাভাবিক জীবন একান্ত কাম্য। এই সময়ই শিশু মেধাবিকাশে আগামী দিনের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর একটি নিজস্ব জগত্ গড়ে ওঠে, তাতে আমাদের বাধা দেওয়া উচিত নয়। শিশুদের মৌলিক মানবিক বিষয়ের মধ্যে চিত্তবিনোদন একটি। তাই তার সঠিক বিকাশে সুস্থ ও শিশুবান্ধব বিনোদনের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। শনিবার (৪ জানুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, চিকিৎসকরা বলেন, পিঠে ব্যথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট নিয়ে শিশুরা তাঁদের কাছে আসছে। এদের প্রায় সবাই বলছে, স্কুলব্যাগের ওজন বেশি। বহন করতে কষ্ট হয়। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুলসহ সব প্রতিষ্ঠানের শিশুদের কাছ থেকেই তারা এমন অভিযোগ পেয়েছেন। শিশুরা মাঝে মাঝেই পিঠব্যথায় কাতরায়। কোনো কোনো দিন ব্যথা ঘাড় বা পায়েও ছড়িয়ে পড়ে। শিশু অস্থিবিদ্যা বিভাগের চিকিত্সকরা বলেন, একটি শিশু তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ওজনের বোঝা বয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এই বোঝা স্কুলব্যাগের বোঝা। এই বোঝাটা কমাতে হবে। আগে জীবন বাঁচাতে হবে, তারপর লেখাপড়া। চিকিত্সকরা আরো বলেন, পিঠে-ঘাড়ে ব্যথার কারণ যে ভারী ব্যাগ, অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। ফলে বাচ্চাকে অনেক দেরিতে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে আসেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয়। পরীক্ষা ও পাঠ্যবই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ শিশুর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও বিশিষ্ট লেখকেরা বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয়। পরীক্ষা খুব বেশি। প্রচুর বই, এত বইয়ের দরকার নেই। ক্লাসরুমে পড়াশোনা হচ্ছে না। তাই কোচিং সেন্টারে যেতে হচ্ছে। গাইড বই কিনতে হচ্ছে। শিশুদের বই বেশি থাকলে ব্যাগের ওজন বেশি হচ্ছে, এতে শিশুর শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া বেশি বইয়ের কারণে লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশুরা এখন লেখাপড়াকে ভয় পায়, লেখাপড়া থেকে আনন্দটা হারিয়ে গেছে।
আগে বেশির ভাগ স্কুল ছিল খোলামেলা। শিশুরা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ পেত। এখন ঢাকাসহ বড়ো শহরগুলোতে কিছু সরকারি স্কুল বাদে বেশির ভাগ স্কুলেই পর্যাপ্ত খেলার জায়গা নেই। শিশুরা যতক্ষণ স্কুলে থাকছে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। সেখানে কোনো বিনোদন নেই। এ কারণে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
শিশুদের পড়াশোনা হওয়া উচিত বিনোদননির্ভর, যাতে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে। সিলেবাস এমনভাবে তৈরি হওয়া উচিত যেখানে বিনোদনের বিষয়টি সম্পৃক্ত থাকে। সেজন্য প্রয়োজনে স্কুলশিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সঠিক দিকনির্দেশনা যেমন শিশুকে আগামী দিনের একজন সফল মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারে, তেমনি ভুল নির্দেশনাও একটি শিশুকে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই সন্তানের যত্ন নিন, পড়াশোনার জন্য কেবল চাপ না দিয়ে তাকে পড়তে উত্সাহিত করা উচিত। শিক্ষার আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী আপনার শিশুকে স্পর্শ করুক। ভালো থাকুক, ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক প্রতিটি শিশু। বাংলাদেশে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনা হয়। শিক্ষা গবেষকদের মতে, শিশুদের পাঠদানের পুরো পদ্ধতিই নতুন করে ঢেলে শিশু উপযোগী করা উচিত। শিশু শিক্ষার যে ব্যবস্থাটা আমাদের দেশে রয়েছে, তা যথার্থ নয়। এটাতে আরো পরিবর্তন আনা দরকার, উন্নতি সাধন করা দরকার। যাতে করে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়তে পারে। এছাড়া পরীক্ষার চাপ থেকে শিশুদের মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের পরীক্ষা থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্কুলের পড়া আর অভিভাবকদের চাহিদার চাপে পড়ে শিশুদের সোনালি শৈশবটিই হারিয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। এটা নিয়ে কোনো পর্যায়েই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই। এই কচি প্রাণগুলোর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। সব শিশুকে নিয়ে একটি সুন্দর পৃথিবী আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
সৈয়দ ফারুক হোসেন : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।