শিক্ষা আনন্দময় ও আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে সকল শিশুর জন্য অভিন্ন কর্মঘণ্টা, পাঠ্যবই ও আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রয়োজন। বৈষম্য অবসানের জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের প্রিয় এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে সুখী, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সে প্রেক্ষাপটে তিনি দেশের চরম অভাবের মাঝেও ১ জুলাই ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন।
তারই পথ অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রাক-প্রাথমিক-ইবতেদায়ি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিনামূল্যে প্রদান করেন। বর্তমান সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিশুদের জন্য বিশাল উদ্যোগ সারা বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এত দুঃসাহসী কর্মের পরও জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের সন্তানদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। শিক্ষাবান্ধব সরকার বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, লাইব্রেরি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু, প্রাক-প্রাথমিক সুসজ্জিত শ্রেণি চালু, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, দপ্তরি কাম প্রহরী নিয়োগ, ওয়াস ব্লক নির্মাণসহ অসংখ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এত কিছুর পরেও সরকারি প্রাথমিকে রয়েছে শিক্ষার্থী সংকট। ‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মতো। তার অন্যতম কারণ হলো, কিন্ডার গার্টেন ও প্রাথমিকের কর্মঘণ্টা এবং পাঠ্যবইয়ের বিশাল ব্যবধান। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের পারিবারিক কাজে সহযোগিতা, সকালে আরবি পড়া ও বিকেলে খেলাধুলা বা একটু বিশ্রামের সুযোগের প্রতি গুরুত্ব দেন। তাই প্রাথমিকের কারাগারের মতো সময়সূচি তারা মেনে নিতে পারেন না।
অপরদিকে, অভিভাবকদের বেশির ভাগের বদ্ধমূল ধারণা, বেশি বইয়ে তাদের সন্তানদের বেশি জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করবে। আমাদের দেশের অভিভাবকদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে বহির্বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। তাদের ধারণা পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থী তথা শিক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর। বর্তমানে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না হলে মেধা বিনাশকারী বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কিন্ডার গার্টেনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সকল শিশুর অভিন্ন বই, কর্মঘণ্টা ও আদর্শ মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু না হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। সবচেয়ে বেশি আঘাত আসবে প্রাথমিকের শিক্ষকদের ওপর। কর্মকর্তারা বলবে, শিক্ষার্থী কম কেন? শাস্তি গ্রহণ করুন। জনসাধারণ ব্যঙ্গ করে বলবে পরীক্ষা নেই, অল্প বই ও কারাগারের মতো সময়সূচি, বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা শুধু সরকারি টাকা অপচয় করেন। মাঝখানে পাটায়-পুতায় ঘষাঘষি মরিচের দশার মত প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা ‘যত দোষ সব নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মতো।
শিশু শিক্ষার্থীদের অভিন্ন কর্মঘণ্টা ও বইয়ের দাবিতে ২১ মার্চ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে প্রধানমন্ত্রী সমীপে স্মারকলিপি পেশ করেন। সংবাদটি অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছে। ২২ মার্চ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কর্মঘণ্টা কমানোর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ৩০ মার্চ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে কুড়িগ্রামের ভূরঙ্গামারীর পাটেশ্বরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা কমানোর পাশাপাশি কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বইয়ের ভারে শিশুরা ক্লান্ত। এ বই তাদের মেধা নষ্ট করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী ১৩ মার্চ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ অনুষ্ঠানে বক্তব্যে শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। এর ফলশ্রুতিতে ১ম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষাসহ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সকল পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশনায় মূল্যায়ন পদ্ধতি কাজ শুরু করবে সংশ্লিষ্টরা।
অভিন্ন মূল্যায়ন ব্যবস্থা সকল শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না হলে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে। কারও কারও মতে, কঠোর শাসন ও পরীক্ষা ছাড়া শিশু শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন ও বিকাশ সম্ভব নয়। এ ধারণা সেকালের। লেখাপড়া ও পরীক্ষার ভীতি ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন শিশু মনোবিজ্ঞানীরা।
শিশুরা আনন্দদায়ক পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেলে সে শিক্ষা হবে অত্যন্ত ফলপ্রসূ। তাই একনাগাড়ে ক্লাসের পরিবর্তে ফাঁকে ফাঁকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন ও বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সে শিক্ষা হবে আনন্দদায়ক ও অধিকতর কার্যকর। পাঠের প্রয়োজনে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা বার্ষিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
মৌলিক একাডেমি সব শ্রেণির জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশ্ন পুস্তিকা প্রণয়ন করা উচিত। প্রশ্ন পুস্তিকায় যাতে শিক্ষার্থীর সব জ্ঞান যাচাই হয় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ প্রশ্ন পুস্তিকা অনুসরণ করে শিক্ষক প্রতিদিন পাঠের মাঝে বা শেষে, অধ্যায় বা গল্প পাঠের শেষে মৌখিক বা লিখিত মূল্যায়ন করবেন। দুর্বল বা অনুপস্থিত শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ পাঠ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করাবেন। পাঠ্যবই হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিশুর জন্য নিজে নিজে পাঠ্যবই দেখে প্রশ্ন তৈরি করা ও উত্তর লেখার সুযোগ থাকতে হবে। বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক, ফটোস্ট্যাট মেশিন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরীক্ষা বন্ধ হলে নোট-গাইড, কোচিং সেন্টারের ব্যাপকতা কিছুটা হলেও কমবে। শিশুকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি, নোট-গাইড বই কেনা থেকে মুক্তি পাবেন অভিভাবকরা।
বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো। ডিগ্রিবিহীন ডাক্তার যেমন লক্ষণ দেখে বা শুনে ওষুধ দিয়ে থাকেন, তেমনি বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতেও অধ্যায় বা পুরো বই থেকে কতিপয় প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান যাচাই করা হয়। হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসায় যেমন অনেক ক্ষেত্রে রোগীর দেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তেমনি বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে জিপিএ-৫ পেয়েও শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি তথা নানা ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে দেখেছি। ওষুধ খেয়ে অসুস্থ থাকা যেমন প্রকৃত চিকিৎসা নয়; তেমনি জ্ঞান অর্জন ছাড়া পাস কোনো কার্যকর শিক্ষা নয়। দেহের সব অঙ্গ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিপূর্ণ চিকিৎসা পেয়ে রোগী যেমন সুস্থ জীবন-যাপন করতে পারে, শিক্ষার্থীও তেমনি তার সার্বিক কর্মকাণ্ডের পরীক্ষার মাধ্যমে আদর্শ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থায় শুধু লিখিতভাবে খানিকটা জ্ঞান যাচাই করা হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশ্ন পুস্তিকার মাধ্যমে লিখিত মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর বাহ্যিক জ্ঞানও যাচাই করতে হবে। যেমন রিডিং স্কিল, বিদ্যালয়ে সময় মতো আগমন-প্রস্থান, নখ-চুল-দাঁত নিয়মিত পরীক্ষা করা। বাথরুম ব্যবহার, জাতীয় দিবসের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, নিয়মিত সমাবেশে যোগদান, জাতীয় ইতিহাস তথা বাঙালি সংস্কৃতি এবং নিজ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ও ধর্ম পালন, পরিষ্কার-পরচ্ছিন্নতা যাচাই, নিজের কাজ নিজে করে কিনা, পাঠ্যবইয়ের বাইরে পত্র-পত্রিকা, গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গঠন ইত্যাদি। এক কথায়, শিক্ষার্থীর লিখিত মূল্যায়নের পাশাপাশি তাকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্য সব গুণাবলী অর্জনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কার্যকর মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে এক্ষেত্রে সব চ্যালেঞ্জ দূর করতে হবে। পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষকদের ১ম শ্রেণির মর্যাদা, বেতন কাঠামো, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকসহ মূল্যায়নের জন্য ফটোস্ট্যাট মেশিন, কাগজসহ সমুদয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়নে ব্যর্থ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর শিক্ষা বা মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বাণিজ্যভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটুক। আগের মতো নোট-গাইড, কোচিং ব্যবসার প্রসার না ঘটে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
শিক্ষাবিদ, শিশু মনোবিজ্ঞানী, সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের দলমত নির্বিশেষে আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। সকল শিশুর জন্য অভিন্ন আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশু শিক্ষার বৈষম্য দূর হবে।
লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা