বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে ঢাকার বাতাস। এর মধ্যেই ঢাকার বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে । মেট্রোরেলসহ চলমান কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটার দূষণ। আবহাওয়া অধিদপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে।
বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্রিনপিস ও এয়ার ভিজ্যুয়ালের গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকার তথ্য এলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
আদালত ঢাকার বায়ু দূষণ কমাতে ধুলোপ্রবণ এলাকাগুলোতে দিনে দুই বার পানি ছিটানোসহ বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিলেও পরিস্থিতির হেরফের হয়নি খুব বেশি। বর্ষা মৌসুমে বাতাসের মান ভালো থাকলেও শীত এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আবার খারাপ হতে শুরু করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি দপ্তরগুলোর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনও নেই।
জানা যায়, বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা। তারা বলছেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ভালো বলা যায়। এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে মধ্যম মানের এবং ১০১-১৫০ হলে বিপদসীমায় আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ হলে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ হলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। বাংলাদেশের সিটি করপোরেশন এলাকার ১১টি স্থানের বাতাসে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা হয় সিএএসই প্রকল্পের মাধ্যমে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে, চলতি মাসের শুরুতেই ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর মাত্রায় পৌঁছে যায়। ঘুর্ণিঝড় বুলবুল আসার আগে প্রতিদিনই বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার পরিমণ ছিল ১৫০ পিপিএম এর উপরে। বুলবুলের প্রভাবে বৃষ্টির কারণে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ওই পরিমাণ ছিল ১০০ পিপিএম এর নিচে। কিন্তু তারপর আবার তা বাড়তে শুরু করে এবং ১৩ নভেম্বর তা ২৩০ পিপিএমে, অর্থাৎ খুব অস্বাস্থ্যকর মাত্রায় পৌঁছে যায়।
অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, গাড়ির ধোঁয়া ও আশপাশের ইটের ভাটাগুলোর কারণে প্রতিবছর এ সময় বায়দূষণ বেড়ে যায়। এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০০ পিপিএমের নিচে ছিল। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং নির্মাণকাজ জোরেশোরে শুরু হওয়ায় গত ৩-৪ দিনে সেটা আবার উপরে চলে গেছে।
রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে প্রায় সব সড়কেই উড়ছে ধুলা। মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে ভাসানটেক যাওয়ার সড়কটির নির্মাণকাজ চলছে প্রায় এক বছর ধরে। দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সড়কটি সম্প্রসারণ হচ্ছে, পাশাপাশি চলছে নিষ্কাশন নালা বসানোর কাজ। বর্ষায় কাদা আর শুকনো মৌসুমে ধুলা- এ নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে চলতে হচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের।
এই সড়কে প্রতিদিন সকালে একবার পানি ছিটিয়ে যায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি। কিন্তু রোদে পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর আবার ধুলায় ডুবে যায়। একই অবস্থা মিরপুরের কালসী রোড, ইসিবি চত্বর, মিরপুর ১২ নম্বর এলাকায়। এছাড়া উত্তরার বিভিন্ন সড়কেও ধুলার উপদ্রব দেখা গেছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, আজিমপুর, চকবাজার, বেগমবাজার, ইমামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে ধুলা উড়তে দেখা গেছে।
ইমামগঞ্জের এক ব্যাংকের কর্মকর্তা জাকারিয়া হোসেন খান বলেন, বাণিজ্যিক এলাকা ইমামগঞ্জ, বেগম বাজার, চকবাজারে প্রতিদিন ঢাকার বাইরে থেকে অসংখ্য ট্রাকে করে আসে মালামাল। এসব ট্রাকের সঙ্গে আসে ধুলা। কিন্তু ধুলা নিয়ন্ত্রণে নগর কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অনেক সময় দূরদূরান্ত থেকে মালামাল আসে। পাউডার জাতীয় জিনিসপত্র আসে। অল্প বৃষ্টিতে কাদা হয়ে যায়। এছাড়া দুইদিন পর পর রাস্তা খোঁড়ে, মাঝেমধ্যে ম্যানহোল থেকে ময়লা তুলে সড়কে ফেলে। পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে গেছে। আমি কখনই এলাকায় পানি ছিটাতে দেখি না।
তাজমহল সড়কের বাসিন্দা রাশেদুল আলম বললেন, ধুলার কারণে পথ চলতেও সমস্যা হয়। আমি প্রায়ই সাইকেলে চলাফেরা করি। কিন্তু ধুলার কারণে আমার সাইকেল চালাতে খুবই সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে কিছুই দেখিনা। বেশি বিপদে পড়ি বাচ্চকে সাথে নিয়ে বের হলে। চোখে ধুলাবালি গেলে সে খুবই অস্বস্তিতে পড়ে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেশি হতে পারে। এখন আবহাওয়া তো শুষ্ক। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে নিয়ে এ ধরনের রোগ বেশি হচ্ছে। এ সময় শ্বাসতন্ত্রের রোগ ছাড়াও চর্মরোগ, বয়স্ক মানুষের শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা হয়। বিশেষ করে বাচ্চারা এবং বয়স্করা বায়ুদূষণের কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপদেষ্টা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পানির নিজস্ব কোনো উৎসই নেই। ওয়াসার পাম্প থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ছিটায় ডিএসসিসির ১১টি গাড়ি। কিন্তু এ বছর ওয়াসা পানি না দেওয়ায় সড়কে পানি ছিটানো যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গত বছর তারা পানি দিয়েছিল।
পানি ছিটানোয় দক্ষিণের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটির যান্ত্রিক বিভাগের শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত বলেন, এখানকার ১২টি ওয়াটার বাউজার ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় দিনে দুইবার পানি ছিটানো হয়। ডিএনসিসির তিনটি গভীর নলকূপ থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয়। মহাখালী, গাবতলী ও মিরপুরের তিনটি নলকূপ থেকে আমরা পানি নিই। জরুরি প্রয়োজনে ওয়াসা থেকেও নেওয়া হয়। সড়কে যানজট না থাকলে পানি ছিটাতে কোনো সমস্যা হয় না।
নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) প্রকল্পের সাবেক পরামর্শক মাসুদ রানা বলেন, বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে ধুলাবালু, যা নির্মাণকাজ এবং মাটি কিংবা বালু পরিবহন থেকে আসে। আর শুষ্ক মৌসুমে যেহেতু সব বেড়ে যায় এবং এ সময়ে পানির ঘাটতিও থাকে, তাই পানি ছিটিয়ে স্থায়ী কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এজন্য তিনি আবহাওয়ার মতো বায়ুমানের পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছেন, যাতে মানুষ দূষণ এড়াতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারে। কিন্তু দেশের শহরগুলোর বিগত দিনের যে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রকাশিত হয়, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজেই লাগছে না। একিউআই প্রকাশের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো জায়গার মানুষকে সে জায়গার বায়ুর মান সম্পর্কে অবহিত করা হয় যাতে করে তারা সাবধানতা ও নির্দেশনা অনুযায়ী চলে। চব্বিশ ঘণ্টা পূর্বের এবং চব্বিশ ঘণ্টা পরের একিউআই প্রকৃতপক্ষে মানুষকে সে রকম কোনো বার্তা দিতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, আমেরিকান অ্যামব্যাসি তাদের চত্বরে বসানো স্টেশনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের প্রতি ঘণ্টার একিউআই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেশের শহরগুলোতে বায়ুমান ফোরকাস্টিং করে প্রকাশ করা উচিৎ। উন্নত দেশে এমনকি ইন্ডিয়াতেও বায়ুমান ফোরকাস্টিং করা হয়, যাতে দূষিত বাতাস এড়ানোর জন্য আগে থেকেই মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারে। ‘এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট’ ও ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস)’ নামের দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে। এ বছরের জুনে কেস প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার আগে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর ৩১টি স্থানে সার্বক্ষণিক বায়ুমান মনিটরিং কেন্দ্র (ক্যামস) স্থাপন করে বায়ুর গুণাগুণ পরিবীক্ষণ করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বসানো সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি চালানো, রক্ষণাবেক্ষণ ও ডেটা কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত জনবলের সার্বক্ষণিক সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা শাখায় বিদ্যমান অতি স্বল্পসংখ্যক কারিগরি জনবল দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করা কতটা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। শুষ্ক মৌসুমে তীব্র বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে বায়ুদূষণের থাবা আমাদের জাতির স্বাস্থ্যগত, বুদ্ধিগত ও দেশের পরিবেশগত অবস্থাকে পঙ্গু করে দেবে।