শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ব্যবহারে সতর্কতা - দৈনিকশিক্ষা

শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ব্যবহারে সতর্কতা

হোসনে আরা বেগম |

বর্তমানে মোবাইল ফোন যে আমাদের জীবনে কত বেশি অপরিহার্য, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিঃসন্দেহে মোবাইল ফোন প্রযুক্তির একটা বিরাট সংযোজন। এখন মোবাইল ছাড়া নিত্যদিনের কাজ সম্পূর্ণ করা যায় না। হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে, সর্বত্রই মোবাইল ফোনের অপরিহার্যতা লক্ষ্য করা যায়।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মোবাইল ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। এমনকি, ল্যান্ড ফোনের ব্যবহারও কদাচিত্ লক্ষ্য করা যেত। এক ভদ্রমহিলা বলছিলেন যে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাঁচানোর জন্যে মা-বাবা তাদের ছয় ভাই-বোনকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের দাবানল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বাড়ির দিকে না গিয়ে তাদের অন্য দিকে যেতে হলো। তারপর এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। কোথায় তারা আছেন, মা-বাবাকে খবর পাঠাতে পারেননি। ছেলে-মেয়েরা বেঁচে আছে কি নেই, তা মা-বাবা যুদ্ধ শেষের আগে জানতে পারেননি। ভদ্রমহিলা আফসোস করে বলছিলেন, তখন যদি মোবাইল ফোন থাকত, তাহলে তাদের বাবা-মাকে এত কষ্ট পেতে হতো না।

এত যে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয় যন্ত্র মোবাইল ফোন, এর যখন অপব্যবহার দেখি, তখন আমরা আঁতকে উঠি। এখন আবার নতুন উপসর্গ ‘ব্লু হোয়েল গেম’। এটা একটা মরণ ফাঁদ। এই মরণ ফাঁদ যদি শ্রেণিকক্ষে জায়গা করে নেয়, তাহলে সর্বনাশের চূড়ান্ত হবে।

সরকারি বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো, শিক্ষার্থীদের মনের সুকুমারবৃত্তি জাগরিত করা, তাদের মধ্যে অধ্যবসায়ের অভ্যাস গঠন করা, মানবিক গুণাবলি চর্চা করার শিক্ষা দেওয়া এবং একজন সত্, কুসংস্কারমুক্ত, শ্রমশীল, কর্মকুশল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষার্থীদের আদর্শ ও নীতিবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষকদের শিক্ষানীতি অনুযায়ী যে সময় বিন্যাস নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা বিশৃঙ্খলভাবে ঘোরাফেরা করলে কখনই তারা নিয়মানুবর্তী হয়ে পড়াশুনার প্রতি মনোযোগী হবে না।

এদিকে শিক্ষার্থীরা অতি প্রয়োজনীয় যে মোবাইল ফোন, সে মোবাইল ফোনের অপব্যবহারে লিপ্ত হয়ে উঠছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোন সঙ্গে আনা নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বহু শিক্ষার্থী লুকিয়ে-ছাপিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকদেরও শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও বহু শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে মোবাইল বন্ধ রাখছেন না। মোবাইলে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্প-গুজব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কাজ, বাড়িতে কী রান্না হচ্ছে, কী ঘটছে সমস্ত খবরই নেওয়া হচ্ছে। শুধু কি তাই? কেউ কেউ প্রাইভেট ছাত্র-ছাত্রীর নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, কবে, কখন পড়তে আসবে, তাও বলে দিচ্ছেন।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যদি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা অনেক বেয়াড়া হয়ে উঠবে। শিক্ষকদের অমনোযোগিতার সুযোগে অনেক শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে মোবাইল সেটে মেমোরি কার্ড ব্যবহার করে পাশের বন্ধুর সাথে শেয়ার করে বন্ধুর পড়াশুনার মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। এমনকি মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে পর্নো ছবি দেখাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

এক্ষেত্রে শিক্ষক যদি চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে পাঠদান করেন, তাহলে তিনি অনায়াসেই লক্ষ্য রাখতে পারবেন, শ্রেণিকক্ষের ভেতরে শিক্ষার্থীরা কী অঘটন ঘটাচ্ছে। যে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বসে পাঠদান করেন, তার ক্লাসে বিশৃঙ্খলা বেশি হয়। তাই শিক্ষক যদি দাঁড়িয়ে পাঠদান করেন, তাহলে তিনি সমস্ত ক্লাসরুমকে নিজের দৃষ্টির আয়ত্তে এনে শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারবেন।

প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়। কিন্তু এ একেবারেই নগণ্য। তাই শ্রেণিকক্ষগুলোকে সুরক্ষার জন্যে শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ প্রসারিত করতে হবে। তবে শুধু দৃষ্টিকোণ প্রসারিত করলেই চলবে না, একইসঙ্গে শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ব্যবহারে নিজেদেরকে সংযত রাখতে হবে। বরং মোবাইল ফোন শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে না। এটা এমনই একটা যন্ত্র, হাতের কাছে থাকলেই টিপতে ইচ্ছে করে। তাই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে যাওয়ার আগে মোবাইল সেটটি নিজ নিজ লকারে বা নিরাপদ স্থানে রেখে যেতে হবে। তারা নিজেরা মোবাইল সেটটা শ্রেণিকক্ষে না নিয়ে গেলে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার প্রতি আরো একটু বেশি যত্নশীল হয়ে ওদের মোবাইল ফোন শ্রেণিকক্ষে আনতে নিষেধ করতে পারবেন।

কথিত আছে, একদা এক পিতা তার পুত্র যেন মিষ্টি না খায়, সে উপদেশ দেওয়ার জন্যে হযরত মুহম্মদ (স.)-এর কাছে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু নবীজী তখনই তাকে কোনো উপদেশ না দিয়ে সাতদিন পর আসতে বললেন। কারণ তিনি নিজে মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। তিনি নিজে যে জিনিস খেতে পছন্দ করেন, সে জিনিস অন্যকে ছাড়ার উপদেশ দেবেন কেমন করে? তাই তিনি প্রথমে মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছেন। তারপর ছেলেটিকে উপদেশ দিয়েছেন।

যেসব শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাদের এ গল্প থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কোনো শিক্ষক নিজে শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার না করার উপদেশ দিলে শিক্ষার্থীরা সে উপদেশ মানতে চাইবে না। শিক্ষকতা পেশায় যারা আসবেন, তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের আদর্শ হতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই মোবাইল ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারিভাবেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ এবং কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

n লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035569667816162