জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স বা মাস্টার্স কোর্স নিয়ে সচেতন মহলে হতাশার কোনো অন্ত নেই। একেবারে বিরক্তিকর পরিস্থিতি। সবার পক্ষে তো আর শুধু বাগাড়ম্বরে মুগ্ধ থাকা সম্ভব হয় না। এবার কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে একদিন হঠাৎ সহকর্মী মুজিবুল হকের ফোন পেলাম। বেশ ইতস্তত করে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চান, ১৩ মে সোমবার অনার্স নির্বাচনী পরীক্ষায় একটি ডিউটি করতে পারব কি না। তিনি এও জানান, ওই দিন এইচএসসি পরীক্ষার পাশাপাশি একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাও নির্ধারিত থাকায় অনার্স পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ইনভিজিলেটর পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর এবং একই মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে পর পর আরো দুজন সহকর্মী কথা বলায় আমি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে সম্মতি জানাই। বুঝতে পারি, এতে সবাই বেশ আশ্বস্ত হয়েছেন। রোববার (২১ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন বিমল সরকার।
২.
অনার্স প্রথম বর্ষের নির্বাচনী পরীক্ষা। কক্ষে প্রবেশ করলাম ২০ মিনিট আগে। খাতা ও প্রশ্নপত্র বিতরণের কাজটি আমার ছাত্রতুল্য সহকর্মী প্রিয় শাহ আলম ও সোহাগ-হাসানরাই সেরে ফেলে। এলেন মুজিবুল হকও। তাঁদের কাছে জানতে পারলাম, বিল্ডিংয়ের ওপর-নিচ মিলিয়ে মোট চারটি কক্ষে এবং আমারই বিষয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’-এর পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। শুনে বেশ উৎসাহ বোধ করলাম, সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলও বেড়ে যায়। ১০০ নম্বরের এ বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে ডিগ্রি পাস ও অনার্স কোর্সে আবশ্যিক হিসেবে পাঠ্য এবং আমরা দুজন মিলে তা পড়াই। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক কৌতূহল নিয়ে অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমি নিজে একে একে চারটি কক্ষে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীসহ আলাদাভাবে কক্ষওয়ারি পরীক্ষার্থীর সংখ্যাটি নোটবুকে টুকে নিয়ে এলাম। আমাদের কলেজে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে একে একে চারটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। প্রতিটি বিষয়ে শুরুতে ৫০ হলেও বর্তমানে ১০০টি করে আসন। প্রথম বর্ষে চার বিষয়ে মোট প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীই ভর্তি হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দু-চারজন করে কমতে কমতে চারটি বিষয়ে খাতাপত্রে বর্তমানে মোট ৩৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী টিকে রয়েছে। অনার্স প্রথম বর্ষের আনুমানিক এই ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আমার নোটবুকের হিসাব অনুযায়ী নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নেয় ২৫০ জন। অর্থাৎ ১০০ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে নির্বাচনী পরীক্ষা প্রক্রিয়ার বাইরে। কথা সেটা নয়। নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণে এমন অনীহা বা গাফিলতির বিষয়টি বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য সব শ্রেণি কোর্সের বেলায়ও এখন বেশ মামুলি হয়ে পড়েছে। ওই দিন অনুষ্ঠিত চারটির মধ্যে দুটি বিষয়ে মোট ১৩০টি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করি আমি। অনার্সের শিক্ষার্থী হিসেবে একেকটি উত্তরপত্রে কী লিখেছে পরীক্ষার্থীরা, তা-ও আমাকে বেশি বিস্মিত করেনি। কারণ বছর বছর বিভিন্ন ফাইনাল পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও এতে নম্বর ওঠানোর অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। বেশির ভাগ উত্তরপত্রে কী সব লেখা থাকে এবং তা দেখে কী পরিমাণে নম্বর দিই বা দিতে হয়, সব কিছু এখানে উল্লেখ করলে কোনো সুফল পাওয়া তো দূরের কথা, অন্তর্দহন-অন্তর্জ্বালাটাই বোধ করি আরো বাড়বে। অতএব সেটিও এখানে বড় কথা নয়।
৩.
এবার আসল কথাটি বলি। প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। দু-চারজন করে কমতে কমতে ৩৫০ জনের মতো টিকে আছে। প্রথম বছরে পাঠদানের শেষ ধাপ নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নেয় ২৫০ জন। কিন্তু শিক্ষাপঞ্জির হিসাব অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে খুব কম দিনই শ্রেণিকক্ষে গিয়ে আমি শিক্ষার্থীর দেখা পেয়েছি। আরো কথা—ডাকাডাকি করে কিংবা পিয়ন বা উৎসাহী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কোনো রকমে ক্লাসটি নিতে সক্ষম হলেও কখনো, কোনো দিন ক্লাসে ৫০, এমনকি ৪০ জন শিক্ষার্থীর দেখা পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। শুধু আমার ক্লাস নয়, শতকরা ৫০, ৪০, এমনকি ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী বলতে গেলে কোনো বিষয়ের ক্লাসেই তারা উপস্থিত থাকে না। তবে একদিক দিয়ে আশার কথা যে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ওদের খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে না। বোধ করি নির্বাচনী পরীক্ষাও পাস করে ফরম পূরণ করবে তারা। শুধু ফরম পূরণ নয়—প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ, এমনকি চতুর্থ বা শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায়ও উতরে যাবে একেকজন।
৪.
টানা আড়াই মাস ক্লাস বন্ধ থাকার পর গত সপ্তাহে কলেজ খোলা হতেই সহকর্মী শিউলী আক্তার জানান, সামনেই ফরম পূরণ—ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের (পাস) নির্বাচনী পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্রের পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে। শুনে বিস্মিতই হলাম। কী প্রশ্নপত্র বানাব, কাদের জন্যই বা বানাব? ডিগ্রি ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে, অথচ এক বছরের মধ্যে কোনো একটি দিন শ্রেণিকক্ষে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না! কিন্তু নিয়ম-বিধি-রেওয়াজ বলে কথা। প্রশ্নপত্র আমাকে তৈরি করতেই হলো। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান শাখা মিলিয়ে আনুমানিক মোট ১৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৭ জুন অনুষ্ঠিত ইংরেজি (আবশ্যিক) বিষয়ের পরীক্ষার দিন ৩৩ জন অংশ নেয়। তার মানে সংখ্যায় মাত্র এক-চতুর্থাংশ!
৫.
ডিগ্রি (পাস) স্তরে প্রথম বর্ষ যেমন-তেমন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বা চূড়ান্ত বর্ষে শ্রেণিকক্ষে একেবারে ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া যায় না, এটি আজকাল মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। সরকারি আর বেসরকারি কোনো কথা নয়, বলতে গেলে সবখানে একই অবস্থা বিরাজমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজকর্ম, এমনকি বাংলা ও ইংরেজির মতো আবশ্যিক বিষয়ের শিক্ষকরাও চক-ডাস্টার এবং হাজিরা খাতা হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে কোনো শিক্ষার্থীর দেখা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন, অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও এটিই একেকটি কলেজের নিত্যদিনের চিত্র। এমনই একদিন শিক্ষার্থী না পেয়ে শ্রেণিকক্ষের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। সমাজকর্ম বিভাগের মুজিবুল হক ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকর্মী কাজী মঞ্জুরুল ইসলামের দেখা পাই। এ ব্যাপারে তাঁরাও তো আমার মতোই ‘অভিজ্ঞ’। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে এ প্রসঙ্গে মুজিবুল হক আস্তে আস্তে প্রখ্যাত গায়ক হায়দার হোসেনের বিখ্যাত গানটি নিয়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার...।’ ওই গানের আওয়াজটি মনে হয় আমার কানে সারাক্ষণই বেজে চলেছে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক।