শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখায় হরিপুর উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ের চরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
এক সময়ের শিক্ষিত বেকার যুবক এবং চা বিক্রেতা এরফান আলী নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন ব্যতিক্রমী এই বিদ্যালয়টি। বর্তমানে যেখানে সুশিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠছে হতদরিদ্র পরিবারের কয়েক শত শিশু।
অথচ এক সময় উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এরফান আলী পড়ালেখা শেষ করে চাকরি না পেয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছিলেন। তিনি শিক্ষিত যুবক হয়ে বেকারত্বের যন্ত্রণা সইতে না পেরে এক পর্যায়ে বাড়ির পাশে বহরমপুর বাজারে চা রেস্টুরেন্টের দোকান চালিয়ে খুব কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন ।
কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতেন আর ভাবতেন সমাজে পরিবর্তন আনতে ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। আর সেই স্বপ্ন ও ভাবনা বাস্তবায়ন করতে তিনি তার গাঁয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত শিশুদের আলোকৃত করতে নিজ উদ্যোগে ও বাবা নুরুল ইসলামের সহযোগিতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন একটি ব্যতিক্রমী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তাতে এরফান আলী আন্তরিকতার সঙ্গে শিশুদের পাঠদান করেন এবং খুব কম সময়ের মধ্যে এলাকাবাসীকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন উল্লেখ করে এলাকাবাসী বলেন, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের তেমন টাকাপয়সা নেই, তাদের এলাকার ছেলে এরফান আলীর সার্বিক সহযোগিতা ও উদ্যোগ ছিল বলে আজ আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে পারছে।
এরফান আলী ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে নিজের ৩৩ শতক জমিতে বাঁশ-চাটাইয়ের বেড়া ও টিন চাপা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অনুমতি লাভ করে এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারীকরণ হয়। ৪০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০১ জন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে তাদের পড়ালেখার পাশাপাশি বিনোদন ও মনের বিকাশের জন্য স্কুলের পাশে তৈরি করেছেন একটি শিশুপার্ক।
ক্লাস শেষে শিশুপার্কে শিক্ষার্থীরা বিনোদনের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করতে পারছে । সে পার্কে রয়েছে রড-সিমেন্টের তৈরিকৃত হাতি, হরিণ, জিরাফ, বক, টিয়াপাখি, ময়ূরসহ খেলাধুলার নানান উপকরণ। এছাড়া দেয়ালে আঁকা রয়েছে ভাষা শহীদ ও বীরশ্রেষ্ঠসহ বিভিন্ন মনীষীর ছবি ও উক্তি। বিদ্যালয়ের মূল আকর্ষণ মিড ডে মিল, যা শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতে সহায়তা করেছে।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষকের নিজ উদ্যোগে মিড ডে মিল চালুর বিষয়টি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । ওই সময় মন্ত্রিপরিষদের একটি চিঠিতে প্রজ্ঞাপন জারি করেন এবং তার ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মাসিক সমন্বয় সভায় চরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত মিড ডে মিল চালুর বিষয়টি সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে অনুসরণ করার পরিপত্রে প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রধান শিক্ষক এরফান আলী গ্রামের অবহেলিত গরিব শিশুদের সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে এবং ঝরেপড়া রোধ ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য তিনি প্রচলিত রুটিনের বাইরেও বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে পড়ালেখা করান। যার ফলে ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বাইরে কোন প্রাইভেট কোচিং করতে হয় না। প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর ব্যতিক্রমী এমন একটি উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তাগণ। হরিপুর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সুলতান আলরাজী বলেন, চরভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি ব্যতিক্রমী ও উদাহরণ সৃষ্টিকারী স্কুল। এমন উদ্যোগ শুধু ঠাকুরগাঁওয়ে নয় সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল করিম বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী নিজ উদ্যোগে ও গ্রামবাসীর সহযোগিতায় মিড ডে মিল চালু করে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। গ্রামে অবহেলিত, পিছিয়েপড়া শিশুদের এগিয়ে নিতে, এরফান আলীর মতো দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এমন উদ্যোগ নেয়া হলে শিক্ষায় ঝরেপড়া কমে আসবে ।
