সঞ্চয়পত্র স্কিমে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা পুনর্নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি একজন ব্যক্তি একসঙ্গে সর্বোচ্চ কতটি সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগ করতে পারবে এবং সব স্কিম মিলিয়ে সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা কত হবে তা-ও নির্ধারণ করে দেবে সরকার। তবে অবসরপ্রাপ্তদের প্রধান ভরসা পেনশনার সঞ্চয়পত্র এর বাইরে থাকবে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি বন্ডকে এর আওতার বাইরে রাখা হচ্ছে। সুখবর হলো, শারীরিক ও মানসিক অক্ষমরা যাতে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে সে জন্য বিশেষ সুযোগ রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এগুলো নির্ধারণের জন্য একটি ‘সমন্বিত নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সজীব হোম রায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়,অর্থ মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি) বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘বিনিয়োগসীমা কমানোর সিদ্ধান্ত অনানুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হবে।’ তিনি জানান, ইতিমধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পারিবারিক সঞ্চয়পত্র—এ তিনটি স্কিম মিলিয়ে একক নামে ৫০ লাখ এবং যৌথ নামে এক কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারছে না গ্রাহকরা।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার আপাতত কমানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে বিনিয়োগসীমায় কিছুটা লাগাম টানা হচ্ছে।
সূত্র মতে, ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদহার কমানোর পর এবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমায় হাত দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে আবারও সঞ্চয়পত্র কেনায় নিরুৎসাহ করতে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার।
সিডিএমসির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড ও ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে বিদ্যমান বিধান অক্ষুণ্ন থাকবে। তবে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগসীমায় লাগাম টানা হচ্ছে। এ তিনটি স্কিমে আলাদা একক ও যৌথ বিনিয়োগসীমাও কমানোর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ তিনটিতে মানুষ সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে থাকে।
বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ব্যক্তির ক্ষেত্রে একক নামে ৩০ লাখ অথবা যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। তবে প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। এটি চালু হয় ১৯৭৭ সালে। এতে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১.২৮ শতাংশ। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে নগদায়ন করলে প্রথম বছরান্তে ৯.৩৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরান্তে ৯.৮০ শতাংশ, তৃতীয় বছরান্তে ১০.২৫ শতাংশ এবং চতুর্থ বছরান্তে ১০.৭৫ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যায়। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে একক নামে ৩০ লাখ টাকা আর যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। এটি চালু হয় ১৯৯৮ সালে। মেয়াদ তিন বছর। এতে মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যায় ১১.০৪ শতাংশ। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেও নগদায়ন করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথম বছর শেষে ১০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর শেষে ১০.৫০ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। এটি চালু হয় ২০০৯ সালে। মেয়াদ পাঁচ বছর। মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১.৫২ শতাংশ। তবে মেয়াদের আগে ভাঙলে প্রথম বছর শেষে পাওয়া যায় ৯.৫০ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ১০ শতাংশ, তৃতীয় বছর শেষে ১০.৫০ শতাংশ এবং চতুর্থ বছর শেষে ১১ শতাংশ পাওয়া যায়।
সিডিএমসির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পারিবারিক সঞ্চয়পত্র—এ তিনটি স্কিম মিলিয়ে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। আর যৌথ নামে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যাবে। আর এগুলো করা হবে ‘সমন্বিত নীতিমালা’ প্রণয়ন করে। ইতিমধ্যে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর। নতুন নীতিমালায়, শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সমন্বিত নীতিমালায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া থাকবে।
বৈঠকে বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের চেয়ে মানুষকে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড ও ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। সরকারি এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করলে সঞ্চয়পত্রের মতো কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যায়। সঞ্চয়পত্রে মুনাফার ওপর উৎস কর আছে, কিন্তু এসব শেয়ারে বা বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় সম্পূর্ণ আয়করমুক্ত। সুদের হার চক্রবৃদ্ধি। তাই মুনাফা বেশি। তা ছাড়া এতে বিনিয়োগ করলে সরকারকে সুদ ব্যয় গুনতে হয় না। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার ফলে ঋণ ব্যবস্থাপনা ঝুঁকি কমে। এ জন্য বন্ডগুলোর প্রচারে দেশে এবং দেশের বাইরে রোডশো করা হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারের অবস্থা ভালো না, ব্যাংকে সুদ কম। মানুষ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করতে পারছে না। এখন সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমা কমালে মানুষ সঞ্চয়ে নিরুৎসাহ হবে। তবে যেহেতু সরকারের কাছে টাকা নেই, তাই সুদ ব্যয় কমাতে সরকার এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গরিব, অবসরপ্রাপ্তদের চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’ পাশাপাশি এ খাতে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ঠিক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।